টম মেয়েটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। কেউ কাছে আসতে চাইলেই ভয় দেখিয়ে সরিয়ে দিলো দূরে, আর ফাঁকে ফাঁকে শত্ৰুদলের ক্যাপ্টেনকে খুঁজতে লাগলো। সেন্টারাসের লোকজন, ডাওজারের ক্রু আর দস্যুদল ততোক্ষণে মরণপণ লড়াইতে লেগে গিয়েছে। নিচের ডেক থেকে ইঁদুরের মতো আরো অনেকগুলো দস্যু দৌড়ে এলো। এসেই এমন এক আক্রোশে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো যা সচরাচর টমের চোখে পড়েনি আগে। এর কারণ অবশ্য জানা, ওদের আর হারাবার কিছু নেই।
তারপর আচমকাই, ঠিক বাতাসের গতি পরিবর্তনের মতো দস্যুরা রণে ভঙ্গ দিয়ে দিলো। টমের সামনের জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেলো। এটাই সুযোগ ওর ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রমণ করার। ও সামনে এগিয়ে পলায়নরত কয়েকজনকে পেড়ে ফেললো। প্রথমে ও বুঝতে পারলো না ওরা এভাবে পালাচ্ছে কেননা। একটু পরেই গন্ধটা পেলো টম। চারপাশের বাতাসে ভেসে বেড়ানো গান পাউডারের ঝাঝালো গন্ধটা না। এটা হচ্ছে কাঠ আর আলকাতরা পোড়ার শক্তিশালী দম আটকানো গন্ধ।
উদ্দত শত্রু আর জ্বলন্ত জাহাজের মাঝে দস্যুরা শেষমেশ জাহাজটাকেই বাঁচাবে বলে ঠিক করেছে, আর সেজন্যেই সেদিকে দৌড়ে যাচ্ছে যদি জাহাজটা কোনোমতে বাঁচাতে পারে। একজনকে দেখা গেলো ডাওজারের কিনারা দিয়ে লাফ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। টম তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। লোকটা দুই জাহাজের মাঝখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে খোলে বাড়ি খেয়ে পানিতে আছড়ে পড়লো। টম আশেপাশে তাকালো। কালো ধোঁয়া ফাইটিং কককে পুরোপুরি ঘিরে ফেলেছে; জাহাজের কিনারা ছাড়িয়ে আগুন থাকার জায়গার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এখন।
“এটাকে ঐ জাহাজ থেকে দূরে সরাতে হবে,” চিৎকার করে বললো টম। আগুন যদি কোনোভাবে ডাওজারে লেগে যায় তাহলে ওরা সবাই পুড়ে মরবে। যামা ওর বিশাল কুঠারটা দিয়ে ঝুলতে থাকা সব রশি কেটে দিতে লাগলো। ডাওজারের দুজন ক্রু-ও দুটো তরবারি তুলে নিয়ে ওর সাথে যোগ দিলো।
আগুনের শিখা লকলক করে উপরে উঠতেই লাগলো। কিন্তু তখনো জাহাজ দুটো জোড়া লেগেই আছে। উপরে তাকিয়ে টম দেখলো ডাওজারের মাস্তুলের একটা আড়কাঠ দস্যুদের জাহাজটার রশিতে বেঁধে গিয়েছে। ফলে দুটো জাহাজই খুব শক্তভাবে আটকে আছে।
“কুড়ালটা দাও আমাকে।” বলে ও যামার হাত থেকে সেটা নিয়ে মাস্তুলের সাথে বাধা জালটা বেয়ে উঠতে লাগলো উপরে। ডোরিয়ানও উঠলো পিছু পিছু।
জালের ফাঁকগুলোয় পা বাঁধিয়ে টম মাস্তুলের মাথার কাছে উঠে এলো। নিজের জাহাজের ক্যাপ্টেন হওয়ায় এর আগে কখনোই ওকে এতো উপরে উঠতে হয়নি, কিন্তু তবুও দেখা গেলো কাজটায় ভালোই দক্ষ ও।
মাথায় পৌঁছেই আড়কাঠ আর রশিগুলোর স্তূপে কোপ দিতে লাগলো টম। ওর ঠিক নিচেই দেখা গেলো আগুন জ্বলছে। দেখে মনে হচ্ছে আগুনের শিখা ওর জুতোর তলা চাটছে। ধোয়ায় চোখে পানি চলে এলো। ডোরিয়ানও পৌঁছে একই কাজ করতে লাগলো। ও আড়কাঠের উপর চড়ে বসে যে পাশটায় রশিগুলো আটকে আছে সে পাশটা কোপাতে লাগলো।
কিন্তু এরপরেও দেখা গেলো জাহাজ দুটো কেউ কারো বন্ধন ছাড়ছেই না।
“ছুটছে না কেন?”
ডোরিয়ান একটা পেরেকের দিকে দেখালো। ওটার সাথে রশিগুলো আটকে আছে। ও টমের হাত থেকে কুড়ালটা নিয়ে ওটার দিকে এগিয়ে গেলো।
কিন্তু কিছু একটা এসে আড়কাঠটায় আঘাত করলো। টমও টের পেলো কনটা, তারপরেই মাস্তুলের গায়ে হওয়া ছিদ্রটা দেখতে পেলো। ঠিক ডোরিয়ানের পায়ের কাছে। ধোয়ার ভিতর দিয়েই টম দেখতে পেলো দস্যুদলের সর্দার হাতের মাস্কেটটা নামাচ্ছে। সে-ই করেছে গুলিটা।
ও আমাদের দুজনকেই একসাথে মারতে চাচ্ছে, মনে মনে ভাবলো টম। এক মুহূর্ত ইতস্তত না করে ও আড়কাঠের শেষ মাথায় এগিয়ে গিয়ে লাফ দিয়ে ফাইটিং কক-এর পাল ধরে ঝুলে পড়লো। তারপর একটা পাক খেয়ে কিছু একটা ধরে নিজেকে স্থির করার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুই পেলো না। এতো জোরে নিচে পড়তে লাগলো যে ঘষায় ওর হাত পা ছিলে গেলো, তারপর প্রচণ্ড জোরে শক্ত ডেক-এ আছড়ে পড়লো। ধোঁয়া আর হট্টগোলের মাঝে কেউ ওকে খেয়াল করলো না। সবাই পানি ভরা বালতি হাতে ছোটাছুটি করছে, চেষ্টা করছে আগুনের তেজ কিছুটা কমাতে। বাকিরা চেষ্টা করছে সাথের নৌকাটা নামাতে। ওটা নোঙ্গরে আটকে বেখাপ্লাভাবে ঝুলছে।
লেগ্রাঞ্জ মাস্কেটটায় গুলি ভরছে আবার। টম নিজেকে ওর দিকে ছুঁড়ে দিলো। দুজনেই ছিটোকে পড়লো মাটিতে। মাস্কেটটা লেগ্রাঞ্জের শরীরের নিচে পড়লো। লেগ্রাঞ্জ শরীরকে ঝাড়া দিয়ে টমকে ফেলে দিতে চাইলো কিন্তু টমের শরীরে ওজনের জন্যে পারলো না। টম নিজের মোজার ভেতর থেকে ছুরিটা বের করে আনলো।
লেগ্রাঞ্জ কিছু করার না পেয়ে অন্ধের মতো ডেক-এর উপর একটা অস্ত্রের জন্যে হাতড়াতে লাগলো। একটা কামানের নিচে একটা কাঠের মুগুর পড়ে ছিলো, সেটায় হাত লাগলো ওর। শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে ও সেটা দিয়ে টমের মাথায় বাড়ি দিলো। সময়মতো টমের চোখে পড়লো ব্যাপারটা। ও মাথা সরিয়ে ফেললো, ফলে বাড়িটা লাগলো ওর কাঁধে। কিন্তু টমের বন্ধনুক্ত হতে লেগ্রাঞ্জের ওটুকুই যথেষ্ট ছিলো। ও ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে থাকা মাস্কেটটা তুলে নিয়ে টমের দিকে তাক করে ধরেই ট্রিগার টিপে দিলো।
চকমকি পাথরটায় ইস্পাতের ঘষায় ফুলকি ছুটলো। টম চমকে উঠে পিছু হটার চেষ্টা করলো। কিন্তু মাস্কেটটায় মিসফায়ার হলো। ক্রুদ্ধ গর্জন ছেড়ে লেগ্রাঞ্জ অস্ত্রটা উল্টো করে ব্যারেল চেপে ধরে টমের দিকে এগিয়ে গেলো।