খোলটা একেবারে জিনিসপত্রে ঠাসা আর বদ্ধ। টম প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে আগালো, কিন্তু তবুও মাথা উপরের কাঠে ঠুকে গেলো। দস্যুদের লুট করা মালামালের ভিতর দিয়ে আগাতে লাগলো ও। আলো বলতে উপরের কাঠের ফাঁক গলে যেটুকু আসছে সেটুকুই। সেন্টারাসের বাকি লোকজন আর আবালি আর ডোরিও আছে পিছনেই। বাকিদের মধ্যে আছে আলফ উইলসন, টমের বাবার সাথেও জাহাজ চালিয়েছে সে; আবোলির দুই ছেলে, যামা আর তুলা। অন্ধকারে ওদের চোখ জ্বলজ্বল করছে, জাহাজটার দাস ব্যবসা সংক্রান্ত অতীত বুঝতে পেরে ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড ক্ষেপে আছে। ওরা প্রত্যেকেই জানে যে অন্য কোনো পরিস্থিতিতে এখানে আসলে হয়তো ওরা কাঠের ভিতর থেকে মুখব্যাদান করে থাকা এই লোহার কড়াগুলোর সাথে বাধা থাকতো, তারপর সমুদ্রের ওপারে আমেরিকা আর ক্যারিবিয়ানে পশুর মতো বিক্রি হয়ে যেতো; তবে সেটাও নির্ভর করছে যদি শেষ পর্যন্ত ওরা এই খুপরির ভিতর বেঁচে থাকতে পারে, তবেই। ওদের মনে হতে লাগলো এই তক্তাগুলো থেকে যেনো বাতাসে সেই অভাগা লোকগুলোর দুর্দশা আর কষ্টের কান্না আর ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে।
টম মই বেয়ে উঠে সাবধানে মাথা তুললো উপরে। ও যেখানে মাথা তুলেছে সেটা জাহাজের কোয়ার্টারডেক, একেবারে পিছনের মাস্তুলের কাছেই। সামনে গনগনে সূর্যের নিচে শুধু মানুষের লাশ ইতস্তত পড়ে আছে। জ্যান্ত সবাই ডাওজারে গিয়েছে, সেটা লুট করতে। টম পিছনের সবাইকে হাতের ইশারা করলো উপরে উঠে আসতে। ও লম্বা একটা কামানের দিকে ইঙ্গিত করলো। ওটার নল সোজা ডাওজারের খোলের গায়ে গিয়ে ঠেকেছে।
ও দ্রুত আদেশ দিলো, “ওটা টেনে আনো ভিতরে।”
যামা আর তুলা ঝটপট কামানটা যে দড়ি দিয়ে জাহাজের সাথে বাঁধা সেটা টেনে ধরলো। আলফ উইলসন আর অন্য লোকটাও যোগ দিলো ওদের সাথে। সবাই একসাথে টেনে ভিতরে নিয়ে এলো ওটা। ঘড় ঘড় করতে করতে কামানটা নিজের জায়গায় ফিরে আসতেই খোপটা দিয়ে আলো প্রবেশ করতে লাগলো। সেদিকে দিয়ে নিজের মাথা বের করে দিলো টম। দুটো জাহাজই একসাথে চলছে এখন। কিছুক্ষণ পরপর দুটোর খোল বাড়ি খাচ্ছে পরম্পর। আর দুটোর ফাঁকে এক চিলতে পানি ঝিকমিক করছে।
ও নিজের বেল্ট খুলে ফেললো। “আমাকে ধরো, আবোলি।”
আবোলি ওর পা ধরে রাখলো, আর ও কামানের খোপটা দিয়ে শরীর বাকিয়ে মুচড়িয়ে ডাওজারের গা স্পর্শ করলো। কিন্তু ডাওজারের গায়ে কোনো কামানের খোপ নেই। তবে টম জাহাজের লেজের দিকের জানালাগুলো হাতে পেলো, ঠিক ক্যাপ্টেনের কেবিনের জানালা ছিল ওটা। জানালার কাঁচের ওপাশে কয়েকটা অবয়ব নাড়াচাড়া করতে দেখা গেলো, বোঝা যাচ্ছে যে ভিতরে কোনো দামী জিনিস লুকানো আছে কিনা সেটা খুঁজতে পুরো কেবিনটায় তাণ্ডব চালাচ্ছে। টম সাথে সাথে জমে গেল জায়গায়, কিন্তু ওরা নিজেদের কাজে এতো বেশি মগ্ন হয়ে ছিলো যে, দুই জাহাজের মাঝখানের এই গাঢ় অন্ধকারে ওর উপস্থিতি টের পেলো না।
“ধরো দেখি এটা,” একজন ডাক দিলো। “খুব বেশি ভারি!”
ভাঙা জানালা দিয়ে স্পষ্ট লোকটার গলা শোনা যাচ্ছিলো। টম দেখলো আর একজন লোক এসে তার সাথে হাত লাগালো। দুজন মিলে একটা শক্ত বক্স ধরে ঘরের বাইরে নিয়ে গেলো।
কেবিনে আর কেউ নেই। টম আরো খানিকটা মুচড়ে এগিয়ে গেলো, ভাগ্যিস আবোলি শক্ত হাতে ওকে ধরে রেখেছিলো। জানালার ভাঙা কাঁচের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিলো ও, সাবধান থাকছে যাতে কবজি না কাটে। তারপর জানালার হুড়কো খুলে জানালাটা খুলে ফেললো।
“ছেড়ে দাও,” ফিসফিসিয়ে বললো টম। আবোলি ছেড়ে দিতেই ও জানালার গোবরাট ধরে নিজেকে ভিতরে টেনে তুললো। ওর পতনের ধাক্কায় কয়েকটা কুশন ছড়িয়ে পড়লো নিচে। ওগুলো ছিঁড়ে তুলা বের করে ফেলা হয়েছে। ভিতরে যদি দামি কিছু থেকে থাকে তাহলে তা আর নেই।
আবোলি টমের নীল তরবারিটা জানালা দিয়ে পাঠিয়ে দিলো। টম ওটা নিজের কোমরে বেঁধে নিয়ে পিস্তলটা পরীক্ষা করে নিলো। বাকিরাও তততক্ষণে চলে এলো এই জাহাজে। সবাই ভিতরে ঢোকার পর দেখা গেলো নাড়াচাড়ার আর জায়গা নেই।
কেবিনের উপরের ডেক থেকে একটা হাসির হল্লা ভেসে এলো। কি হচ্ছে ভেবে পেলো না টম।
আচমকা খুলে গেলো দরজা। এক দস্যুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো সামনে। সে এতোক্ষণ রান্নাঘরটা লুট করছিলো সম্ভবত, কারণ তার এক হাতে দেখা গেলো এক গাদা রূপার চামচ আর এক হাতে একটা মোমদানি।
“কি করছো তোমরা? এসব আমার।” কিন্তু এরপরেই ওর খেয়াল হলো যে এরা ওর দলের কেউ না। “তোরা আবার কোন শালা?”
কিন্তু কেউ যে তরবারি চালাবে সেই জায়গা ঘরের ভিতরে ছিলো না। আবোলি হাতের ছুরিটাই চালালো শেষ পর্যন্ত। দস্যুর গলা এফোঁড় ওফোড় হয়ে গেলো। গলা চেপে ধরে মেঝেতে পড়ে গেলো সে। গলগল করে হাতের ফাঁক দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো। হাতের চামচ আর মোমদানি ছড়িয়ে পড়লো মেঝেতে।
“আমার পিছনে আসো সবাই!” টম মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলো ঘরটা থেকে। পুরো জায়গাটা কুরুক্ষেত্র হয়ে আছে : লোকজন কাপড়চোপড়ের গাটরি নিয়ে টানাটানি করছে, আলমারি ভেঙ্গে ভিতরের জিনিস ছড়িয়ে ফেলেছে, দামি দামি সব মশলা পুরো মেঝেতে সয়লাব হয়ে আছে। কয়েকজনকে দেখা গেলো রাম-এর একটা পিপা ভেঙ্গে সেটা থেকে খাওয়া। শুরু করেছে।