টম খাপ থেকে তরবারিটা বের করলো, সূর্যের আলো ওটায় প্রতিফলিত হতে ওর চেহারাও আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো।
“কামানগুলো রেডি করে ফেলো আবোলি। দুটো করে তিতির পাখি মারো ওদের দিকে।” তিতির পাখি হলো ছোট ছোট সীসার বল ভরা গোলা। মেঘের মতো ওগুলো ভেসে যায়, আর সামনে যেটা-ই পড়ে সেটা ধ্বংস করে ছাড়ে। “মি. উইলসন, বাতাসের দিকে আরো তিন পয়েন্ট ঘুরিয়ে দিন জাহাজের মুখ।”
*
দস্যুদের বো চেজার আবারও গর্জে উঠলো। একটা গোলা অনেক দূরে গিয়ে পড়লো, আর একটা পিছনদিকের একটা তক্তা ভেঙ্গে বেরিয়ে গেলো, টুকরো কাঠের গুঁড়োয় ভরে গেলো আশপাশ। ইঞ্চবার্ডের গালেও একটা টুকরো এসে লাগলো, উষ্ণ রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগলো সেখান দিয়ে।
দস্যুরা ওদের জাহাজের দিকে পরিবর্তন করে এমনভাবে বাকিয়ে নিলো যাতে ডাজারের সবগুলো মাস্তুল এক সারিতে চলে আসে। ঠিক নাইনপিন খেলার মতো।
“অতো দূর থেকে লাগানো সহজ হবে না,” শান্ত কণ্ঠে বললো মেট।
ওদের ধারণা ভুল প্রমাণ করতে ঠিক সাথে সাথেই উপর থেকে মড়াত করে একটা শব্দ ভেসে এলো। সবার চোখ ঘুরে গেলো উপর দিকে-দেখতে পেলো একগাদা কাঠ আর ক্যানভাসের কাপড় ওদের দিকে ধেয়ে আসছে। সবাই লাফিয়ে সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করলোর কয়েকজন নড়তে দেরি করে ফেললো। হাল ধরে ছিলো যে লোকটা তার ঠিক চাদি বরাবর পড়লো মাস্তুল, মুহূর্তে ভেঙ্গে চুর চুর হয়ে গেলো মাথাটা। বাতাসের উল্টো দিকে ঘুরে গেলো জাহাজ। আর পালটা মৃত লোকটার উপর কাফনের কাপড়ের মতো করে ঢেকে গেলো।
“কেটে দাও ওটা,” চেঁচিয়ে বললো ইঞ্চবার্ড। “হুইলটাকে মুক্ত রাখতে হবে।” লোকজন কুড়াল হাতে ছুটে গিয়ে মাস্তুলের গোড়াটা কাটা শুরু করলো।
আর একটা গোলা ছোঁড়ার শব্দে ওর কথা চাপা পড়ে গেলো। ওর মুখের মাত্র এক ফুট দূর দিয়ে উড়ে গেলো কামানের গোলাটা। ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে পাটাতনের উপর পড়ে গেলো ইঞ্চবার্ড। জাহাজটা এখন একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু। জাহাজের খোলটা কেঁপে উঠলো আবার। আরও একটা মাস্তুল ফাটার আওয়াজ পাওয়া গেলো। জুরা পাল-টাকে সরিয়ে ফেলেছে ততোক্ষণে। সদ্য মৃত লোকটার রক্তে লাল হয়ে আছে ওটা। নিচেই দেখা গুলো হুইলটাও টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে, মাস্তুলটা ঠিক ওটার উপরেই পড়েছিলো। আবার একটা বসাতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যাবে। আর ওদের হাতে মোটেও অতোটা সময় নেই।
এদিকে দস্যুদের জাহাজটা ক্রমেই কাছিয়ে আসছে, আর কিছুক্ষণের মাঝেই পাশাপাশি চলে আসবে। ইঞ্চবার্ড ওটার ডেক-এর লোকজনগুলোকেও দেখতে পাচ্ছে এখন। কয়েকজন তাদের হাতের তরবারি নেড়ে উল্লাস করছে, বাকিদের হাতেও ভয়ালদর্শন লম্বা তরবারি।
ইঞ্চবার্ড দাঁতে দাঁত পিষলো। “জাহাজে কাউকে উঠতে দেবে না।”
*
ফাইটিং ককের হালী ওটাকে ডাওজারের পাশাপাশি নিয়ে এলো। তারপর মাস্তুলের উপরের লোকেরা পাল গুটিয়ে নিলো, আর বাকি দস্যুরা জাহাজের কিনারের কাঠের উপর উঠে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো। ওদের লাফঝাপের চোটে জাহাজ দুটো একটা আর একটার সাথে ধাক্কা খেয়ে দুলতে লাগলো। এখন ওদের মাঝে ব্যবধান মাত্র কয়েক ফুট পানি।
লেগ্রাঞ্জ লাফ দিয়ে রেইলের উপর উঠে দাঁড়ালো। পানির মতোই সহজে হয়ে গেলো কাজটা, সন্তুষ্টচিত্তে ভাবলো ও। মার্চেন্টম্যানের ডেক-এ তাকিয়ে দেখে ওখানে কেউ নেই। কু-রা নিশ্চয়ই ডেক-এর নিচে, পাগলের মতো নিজেদের মূল্যবান সম্পদ লুকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। খামাখা কষ্ট করছে : কিছুক্ষণের মাঝেই ওরা কান্নাকাটি করতে করতে জীবন ভিক্ষা দেওয়ার জন্যে অনুনয় করতে থাকবে, আর কোথায় কি রেখেছে সেসবও সুড়সুড় করে বলে দেবে।
ও কথা বলার জন্যে মুখের সামনে চোঙ্গাটা তুললো। “পতাকা নামিয়ে নাও আর অতিথিদের বরণ করার জন্যে প্রস্তুত হও।”
ওর লোকেরা উল্লাস করে উঠলো। লেগ্রাঞ্জ জাহাজের কামানগুলোর দিকে তাকালো। ওগুলোর একটাতেও কোনো গোলন্দাজ নেই। কক-এর কামানের বহরে এগুলো সংযুক্ত হবে এখন। অথবা ও ডাওজারকেই কিছুটা সংস্কার করে নিজের জাহাজের বহরে যোগ করে নিতে পারবে। দুটো জাহাজ পেলে পুরো সমুদ্রটাই ওর হয়ে যাবে। চিন্তাটা মাথায় আসতেই নেকড়ের মতো ধূর্ত একটা হাসি ফুটলো ওর মুখে।
চোখের কোণে রঙিন কিছু একটা ধরা পড়লো ওর : একটা কমলা আভা, যেন একটা কামানের গোড়ার কাছে কোনো ধাতুর উপর সূর্যের আলো পড়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। ও গলা বাড়িয়ে সেটা দেখার চেষ্টা করলো। ওটা সূর্যের আলো না। ওটা আসলে কামানের সলতেতে লাগানো আগুন, ধীরে ধীরে সেটা গোলার দিকে এগিয়ে চলেছে। দ্রুত বাকি কামানগুলোকে পরীক্ষা করতেই ওর রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। প্রতিটা কামানেই গোলা ভরা, আর সলতেতে আগুন লাগিয়ে ঠিক ওদের দিকেই তাক করে রাখা হয়েছে।
“মাথা নামাও সবাই,” চিৎকার করে উঠলো ও। গোলন্দাজবিহীন কামানগুলো থেকে একেবারে পয়েন্ট ব্লাংক থেকে কয়েকটা গোলা ছুটে গেলো। গোলার সাথে পেরেক ভরে দেওয়া হয়েছে। গোলাটা সোজা জাহাজের একটা পাশকে পুরো চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিলো। একদম সামনে যে লোকগুলো দাঁড়িয়ে ছিলো তারা একেবারে কিমা কিমা হয়ে গেলো বলা যায়, রক্তের হোলি খেলা হলো যেন ওখানে। তাদের পিছনে যারা ছিলো তারাও প্লিন্টারের আঘাতে মারাত্মক আহত হলো। কয়েকটা মুহূর্ত নিঃসীম নিস্তব্ধতায় ডুবে গেলো, কিন্তু তারপরেই ডাওজারের লোকেরা হারে রে রে করতে করতে মাস্কেট আর পিস্তল হাতে দৌড়ে আসতেই আবার আকাশ বাতাস চিৎকার আর গুলির আওয়াজে ভরে উঠলো। ওরা লাফিয়ে কক-এর ডেক-এ উঠে এসে যারা তখনও বেঁচে ছিলো তাদেরকে গুলি করে মারতে লাগলো। কম আহতেরা পায়ের উপর উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই আবার গুলি খেয়ে শুয়ে গেলো। জাহাজ দুটো দূরে সরে যেতে শুরু করতেই ডাওজারের লোকজন উল্লাস করে উঠলো।