“উজবুকের মতো কথা বোলো না টম কোর্টনী,” ঘোষণা দিলো সে। “তুমি আসলেই ঐ বেচারাদেরকে এই জলদস্যুদের হাতে মরতে ছেড়ে দেবে?” টমের হাত থেকে পাই গ্লাসটা ছিনিয়ে নিতে নিতে বললো ও। তারপর নিজের চোখে দিয়ে বললো, “যদূর জানি ঐ জাহাজে একজন মহিলাও আছে। দস্যুরা জাহাজটা দখল করে ফেললে তার কি অবস্থা হবে জানো না?”
যে লোকটা হাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে টম তার সাথে চোখাচোখি করলো। “তোমার কি মনে হয় ডোরি?”
ডোরিয়ান কোর্টনী ভ্রু কুঁচকে ফেললো। ওরা দুজন ভাই। যদিও খুব কম মানুষই সেটা ধরতে পারে। আরবের মরুভূমিতে থাকতে থাকতে ডোরিয়ানের গায়ের রঙ গাড় বাদামী হয়ে গিয়েছে। মাথায় একটা সবুজ পট্টি বাঁধা। ওর লাল চুলের পুরোটাই তাতে ঢাকা পড়েছে প্রায়। ঢিলেঢালা নাবিকদের পায়জামা পরনে ওর। কোমরে একটা বাকানো ছুরি ঝোলানো।
“আমিও ব্যাপারটা ঠিক মানতে পারছি না।” হালকা চালেই বললো ডোরি। কিন্তু সবাই জানে ওর কথার পিছনে আসলে কতোটা তিক্ততা লুকিয়ে আছে। মাত্র এগারো বছর বয়সে ওকে দস্যুরা ধরে নিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। প্রায় দশ বছর খোঁজার পর টম আবার ওকে খুঁজে পায়। সবাই ভেবেছিলো মারা গিয়েছে ও। ডোরিয়ানকে কিনেছিলো মাস্কটের এক হিতৈষী রাজকুমার। ও তার বাড়ির একজন প্রহরী হিসেবে কাজ শুরু করে। পূর্ব আফ্রিকার মরুভূমিতে আবার যখন ওদের দেখা হয় তখন টম ওকে চিনতেই পারেনি। বলা যায়, মাত্র এক চুলের জন্যে ওরা একজন আর একজনকে খুন করে ফেলেনি সেবার।
“ব্যাপারটা মোটেও সহজ হবে না ক্লিবি,” আবোলি সতর্ক করলো। টমকে ও ক্লিবি নামে ডাকে; ওর মাতৃভাষায় এর মানে হচ্ছে বাজপাখি। দাস ব্যবসায়ীদেরকে আবোলি ভয়াবহ মাত্রায় ঘৃণা করে। ও আফ্রিকার লোজি উপজাতিদের একজন। ওর দুজন স্ত্রী-জিতি আর ফাল্লা। তাদের গর্ভে ওর ছয়টা বাচ্চা জন্ম নেয়। একবার ব্যবসার কাজে আবোলি অনেক দূরে গিয়েছিলো। সেই ফাঁকে আরব দাস ব্যবসায়ীরা গ্রামে আক্রমণ করে ওখানকার লোকজনকে ধরে নিয়ে যায়। তার মাঝে জিতি, ফাল্লা আর আবোলির বড় দুই ছেলে-ও ছিলো। বাকি বাচ্চাদেরকে মেরে রেখে যায়। আবোলির ছোট ছোট চারটা ছেলেমেয়েকে গাছের গুঁড়ির সাথে আছাড় মেরে মাথা ফাটিয়ে মেরে ফেলা হয়। কারণ ওরা এতো ছোট ছিলো যে ওদেরকে পূর্ব তীরের দাস বাণিজ্যের এলাকায় জোর করে নিয়ে গিয়ে কোনো লাভ হতো না।
টম আর আবোলি পুরো আফ্রিকা জুড়ে দস্যুগুলোকে খুঁজে খুঁজে মেরেছে। ক্লান্তির চরম সীমায় পৌঁছেও হাল ছাড়েনি। এর মধ্যেই জিতি, ফাল্লা আর ওদের জীবিত দুই ছেলেকে মুক্ত করে ওরা। আর দাস ব্যবসায়ীদের উপর চরম প্রতিশোধ নেয়। ছেলে দুটো, মানে যামা আর তুলা এখন প্রায় তরুণ। আবোলি ইদানীং ওদের মুখেও ঐ শাস্ত্রীয় চিহ্ন দেওয়ার কথা ভাবছে। টম জানে ওরাও চিহ্নটা অর্জন করার জন্যে অধীর হয়ে আছে।
“জাহাজটা তো পুরো বোঝাই হয়ে আছে, ডোরিয়ান বললো। মনে হলো যেনো এইমাত্র ব্যাপারটা টের পেয়েছে ও। “মুক্তিপণ আদায়ের জন্যে একেবারে মোক্ষম জিনিস।”
আবোলি এর মধ্যেই ওর পিস্তল প্রস্তুত করা শুরু করেছে। “তোমার বাবা কি বলতেন জানো নিশ্চয়ই।”
“সবারই উপকার করো, কিন্তু করা শেষে নিজের ফী-টা নিতে ভুলো না।” টম হেসে বললো। “সে যা-ই হোক, কিন্তু মেয়েমানুষ সাথে থাকলে কোনো ঝামেলায় জড়ানো আমার ঠিক পছন্দ না।”
সারাহ ডেকের নিচে গায়েব হয়ে গেলো। একটু পরেই ফিরে এলো একটা সোনালি হাতলওয়ালা তরবারি হাতে করে। হাতলের মাথায় একটা নীলকান্ত মণি ঝিকমিক করছে।
“তুমি কি যাবে টম কোর্টনী? নাকি আমাকেই করতে হবে কাজটা?” জানতে চাইলো ও।
সাগর জুড়ে আরো একটা গোলার আওয়াজ ছড়িয়ে পড়লো। এবার অবশ্য মার্চেন্টম্যানটা থেকে কয়েক টুকরো কাঠ উড়ে যেতে দেখা গেলো।
‘হায় খোদা, মিসেস কোর্টনী, আমারতো মনে হয় এমনকি দস্যুরাও তোমার কথা অমান্য করার চাইতে বরং মুঘল সাম্রাজ্যের গুপ্তধনে ভরা ঐ জাহাজটাকে ছেড়ে দেওয়াই বেশি পছন্দ করবে। তুমি কি বলল, ইয়াসমিনি?” শেষের কথাটা ও বললো সারাহের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরি আরব মেয়েটাকে। ও হচ্ছে ডোরিয়ানের স্ত্রী, পরনে একদম ছিমছাম একটা পোশাক, মাথায় একটা সাদা ওড়না।
“একজন ভালো স্ত্রী সর্বাবস্থায় তার স্বামীকে মান্য করে,” বিনয়ী কণ্ঠে বললো ও। “আমি আমার ওষুধের বাক্সটা গুছিয়ে নিচ্ছি। সন্দেহ নেই আপনাদের কাজ শেষ হওয়ার আগেই আমার কাজ শুরু হয়ে যাবে।”
টম নীল তরবারিটা কোমরে গুঁজে নিলো। ওটার নাম নেপচুন। একসময় তরবারিটা ছিলো ওর বাবার, তার আগে ওর দাদার। তবে এটার প্রথম মালিক ছিলো ওর পরদাদা চার্লস কোর্টনি। স্পেনের র্যাঞ্চেরিয়া জয়ের পর স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক তাকে এটা উপহার দিয়েছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে তরবারিটা পাওয়ার কারণে টম এখন টেম্পল অফ দ্য অর্ডার অফ দ্য হলি গ্রেইল-এর একজন নাইট নটোনিয়ার। ওর উত্তরসূরিদের মতোই ও এটা দিয়ে অসংখ্য লোককে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছে। তবে সেসব মৃত্যু ওদের পাওনা ছিলো। তরবারিটা একেবারে খাঁটি টোলেডো ইস্পাতের তৈরি, আর হাতলের নীলাটার জন্যে ফলার ওজনটাও চমৎকারভাবে ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে।