ফ্রান্সিস টাকার অঙ্কটা একবার কল্পনা করার চেষ্টা করলো। বিশাল একটা গাড়িতে করে হাই উইল্ডে ফিরে আবার বাড়িটা দখল নেওয়ার কথা ভাবলো। ওর মাকে আবার ওখানকার কত্রী হিসেবে দেখার কথা ভাবলো। জায়গাটাকে আবার সেই ছোট বেলার মতো আনন্দ আর খুশিতে ভরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবলো।
ওয়াইন খাওয়ার কারণে ওর গরম লাগতে লাগলো। ও জানে যে এরকম অনেকক্ষণ উপোস থাকার পর এভাবে দ্রুত পান করা ঠিক না, কিন্তু ও থামাতে পারছিলো না। ও বুঝতে পারছিলো যে ওর আরো কিছু প্রশ্ন করা দরকার, গাই টম আর ওর উত্তরাধিকারের ব্যাপারে। কিন্তু চিল্ডসের স্বর শুনে বোঝা গেলো এ ব্যাপারে উনি আলাপ করতে আগ্রহী না। উনি যখন আরো ওয়াইন ঢেলে দিলেন ফ্রান্সিস কৃতজ্ঞচিত্তেই সেটা খেয়ে নিলো।
“এই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যেই তুমি সারা জীবন ধরে অপেক্ষা করছো,” চিল্ডস বললেন। “আমাদের দুজনেরই পাওনা কড়ায় গণ্ডায় আদায় হবে এবার।”
সেন্ট জর্জের পদকটা তখনো টেবিলেই পড়ে আছে, অর্ধেকটা এক তাড়া কাগজের নিচে ঢাকা। ফ্রান্সিস ওটা তুলে নিতেই চিল্ডসের চেহারা বেজার হয়ে গেলো, কিন্তু ফ্রান্সিস সেটা খেয়াল করলো না। এতোটা মদ খেয়ে ও এখন ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না।
“আমার বাবার ইজ্জতের কসম, স্যার নিকোলাস। আমি টম কোর্টনীকে খুঁজে বের করে তাকে তার উপযুক্ত শাস্তিই দেবো।”
*
টম আর ডোরিয়ান পানশালার বাইরে বসে আছে। মাঝে মাঝে পানপাত্রে চুমুক দিচ্ছে আর টেবিল উপসাগরে নোঙ্গর করে থাকা জাহাজগুলোর দিকে নজর বুলাচ্ছে। টম খাচ্ছে মিষ্টি সুগন্ধযুক্ত ওয়াইন, তবে ডোরিয়ান ওর নতুন গ্রহণ করা ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী সব ধরনের মদ জাতীয় পানীয় পরিহার করে চলে। তাই ও খাচ্ছে কমলার রস। ওদের পিছনে টেবিল পর্বত আকাশ জুড়ে আঁকারাকা রেখা টেনে ফুটে আছে। ডেভিলস পিক আর লাতনক পিক এর ছোট চূড়াগুলো উপসাগরকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছে যে, মনে হচ্ছে কোনো প্রাকৃতিক গ্যালারি। পাহাড়ের ঢালের জঙ্গলের নিচে প্রায় শ-খানেক সাদা রঙ করা পাথুরে বাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। উত্তর প্রান্তে একটা দুর্গ, নেদারল্যান্ডের তিনরঙ্গা পতাকা উড়ছে সেখানে। দুর্গে পাঁচটা গম্বুজ। দেখেই বোঝা যায় এই উপনিবেশে কারা ক্ষমতাবান।
একটা ইন্ডিয়াম্যান (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ) হেলে দুলে ঘাটের দিকে এগিয়ে আসছে। গায়ের রঙ আর দড়াদড়ির অবস্থা দেখে টম বুঝলো ওটা ইংল্যান্ড থেকে এবারই প্রথম সমুদ্র নামানো হয়েছে। জাহাজটার আগমনের ফলে কি কি হতে পারে সে ব্যাপারে দ্রুত হিসাব করে নিলো টম। আইভরির দাম বেড়ে যাবে, কারণ এই ইংরেজ ব্যবসায়ীরা ভারত পর্যন্ত যাওয়ার জন্যে রসদপত্র কিনবে; বিনিময়ে ওরা দেবে ইংল্যান্ড থেকে আনা ছুরি আর ইস্পাতের পাত্র। জাহাজটা দেরি করে এসেছে, বেশিরভাগ আইভরিই বিক্রি হয়ে গিয়েছে। তবে টম গতবারের অভিযান থেকে আনা কয়েকটা হাতীর দাঁত কি মনে করে যেনো রেখে দিয়েছিলো। এখন এদের কাছে কতোটা লাভ করতে পারবে সেই চিন্তা মাথায় আসতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো ওর।
একটু পরেই টম আর ডোরিয়ান, ওরা যে বোর্ডিং হাউসটায় উঠেছে সেটায় ফিরে যাবে। কেপ টাউনে ওরা সবসময় ওখানেই থাকে। আমস্টারডাম ব্যাঙ্কের একটা অফিস আছে এখানে। সেটায় দশ হাজার পাউন্ড জমা আছে টমের, কিন্তু ও সেটা দিয়ে নিজের বাড়ি বানানোর চেষ্টা করেনি কখনো। ডাচ কর্তৃপক্ষ ভিনদেশী কাউকে এই উপনিবেশে বাড়ি বানানোর ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। তবে জায়গা মতো কিছু রিক্স-ডলার (সাউথ আফ্রিকার তৎকালীন মুদ্রা) ছাড়লেই নিষেধের বেড়াজাল আলগা হয়ে যায়। টম অবশ্য কখনো চেষ্টা করেনি। বছরের পর বছর ধরে ও মৌসুমের শেষ সময়টা এই বোর্ডিং হাউসেই কাটিয়ে দেয় আর ধৈর্য ধরে পরের মৌসুম শুরুর অপেক্ষা করে।
“বিরক্ত হয়ে গিয়েছে নাকি টম?” ডোরিয়ান জিজ্ঞেস করলো। জবাবে টম ওর হাত সামনে বাড়িয়ে পাহাড়, সমুদ্র, আর তার উপরের তুলোর পেজার মতো মেঘ আর দিগন্তে ডুবতে বসা সুর্যের দিকে দেখালো। “এতো কিছু থাকার পরেও বিরক্ত কিভাবে হই বলো তো?”
“আমি তোমাকে খুব ভালোই চিনি, ভাইয়া,” মৃদু হেসে বললো ডোরিয়ান “ঐ দস্যু লেগ্রাঞ্জের হাত থেকে ডাওজারকে উদ্ধার করে আনার পর থেকে তুমি একটা বারও বন্দুকের গুলি ছোড়োনি। আর সেটাও ঘটেছিলো প্রায় এক বছর আগে।”
এবার আফ্রিকায় হাতীর দাঁত সংগ্রহের অভিযানটা ছিলো একেবারেই সাদামাটা। টম আর ডোরিয়ান জাম্বেসি নদীর প্রায় দুইশো লীগ পর্যন্ত ভিতরে অভিযান চালায়, কিন্তু এর আগে যেসব দাস ব্যবসায়ীদের সাথে ঝামেলা বেধেছিলো তাদের কারো সাথেই এবার আর দেখা হয়নি। এমনকি শিকারও বিগত বছরগুলোর মতো হয়নি। সেন্টারাস এবার মাত্র অর্ধেক খোল ভরে আইভরি নিয়ে ফিরে এসেছে।
“ঝামেলায় জড়ানো ব্যবসার জন্যে ক্ষতিকর,” দৃঢ় বিশ্বাসীর ভঙ্গিতে বললো টম।
তারপর দিগন্তে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেলো ও। চোখ পিট পিট করে দেখলো কয়েকবার। যেখানে সূর্যের শেষ কিরণটাও মিলিয়ে যাচ্ছিলো সেখানে এমন সবুজ একটা রঙ দেখা গেলো যা টম এর আগে কখনোই দেখেনি। একেবারে চমকে গেলো ও; যদিও এরকম ঘটনার কথা আগেও শুনেছে, কিন্তু এবারই প্রথম চাক্ষুষ দেখার ভাগ্য হলো।