“আমি নিশ্চিত এ ব্যাপারে আপনার কিছুই করার ছিলো না, স্যার, “ ফ্রান্সিস প্রতিবাদ করলো।
তবে ওর মায়ের বলা কথাগুলো মাথায় আসতেই ওর মনে একটা অসুস্থ চিন্তা আবার নাড়া দিয়ে গেলো।
“আমি কি আপনাকে বিশ্বাস করে একটা কথা বলতে পারি?”
“অবশ্যই। নিজের বাবা মতো ভাবতে পারো আমাকে।”
“বাড়ি ছেড়ে আসার আগে আমার মা খুব আজব একটা কথা বলেছিলেন। উনি বলেছিলেন যে উনি বিশ্বাস করেন টম চাচা নাকি আসলে নির্দোষ। উনি নাকি বাবাকে মেরেছিলেন নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে।”
চিল্ডস এতো জোরে মাথা নাড়লেন যে ওনার থলথলে থুতনী দুলতে লাগলো। “উনি ভুল ভেবেছেন। আসলে অধিক শোকে ওনার বুদ্ধি ঠিকমতো কাজ করছে না। বেচারী! উইলিয়াম কোর্টনী যেদিন মারা যায় আমি সেদিন তাকে হাউস অফ লর্ডসে দেখেছিলাম। নিজের ভাইয়ের ব্যাপারে যে দুশ্চিন্তার কথা সেদিন ও বলেছিলো বা তার জন্যে যে ভালোবাসা আর স্নেহের ভাব আমি দেখেছিলাম সেটা ছিলো সম্পূর্ণ খাঁটি। সেদিনই উইলিয়াম আমাকে বলেছিলো যে ও টমকে দশ হাজার পাউন্ড দেবে, যাতে টম একটা জাহাজ নিয়ে ওদের ভাই ডোরিয়ানকে উদ্ধার করে আনতে পারে। ডোরিয়ানকে দস্যুরা ধরে নিয়ে গিয়েছিলো-পরে জানা যায় যে ছেলেটা মারা গিয়েছে। তবে সেটায় টম কোর্টনীর লোভ মিটলো না। ও টেমসের ধারে উইলিয়ামকে পিছন থেকে আক্রমণ করে ওর বাবার সম্পত্তির আরো বেশি ভাগ দাবি করে। উইলিয়াম রাজি না হতেই ও নির্দয়ের মতো ওর গলা কেটে মেরে ফেলে।”
দৃশ্যটা কল্পনা করে ফ্রান্সিস শিউরে উঠলো। “আপনি নিশ্চিত?”
“এক মাঝি পুরো ঘটনাটা দেখেছিলো। ও আমাকে সব বলেছে। এমনকি এতোদিন পরেও আমার সব মনে আছে।”
একজন চাকর দরজায় আঘাত করে একটা রূপার ট্রে হাতে ভিতরে ঢুকলো। তারপর খাবারের পাত্রগুলো চিল্ডসের ডেস্কে নামিয়ে রাখলো। ঝলসানো মাংস দেখা গেলো ওগুলোয়। দুই গ্লাস ক্লারেট মদ ঢেলে দিয়ে সে বিদায় নিলো। ফ্রান্সিস আর দেরি না করে বলা চলে ঝাঁপিয়ে পড়লো খাবারের উপর।
চিল্ডসও প্রায় ফ্রান্সিসের মতোই বুভুক্ষের মতোই খেতে লাগলেন। ওনার গাল বেয়ে ঝোল পড়ে জামার সামনের দিকটা ভরে গেলো।
“তুমি কি বাবার মৃত্যুর বদলা নিতে চাও?” প্রশ্নটা করতে গিয়ে চিল্ডসের মুখ থেকে খাবারের কণা ছুটে বেরিয়ে এলো। বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার বলা শুরু করলেন, “অবশ্যই তুমি চাও। তুমি একজন কোর্টনী। আর তোমার শরীরে কেমন রক্ত বইছে সেটা আমার ভালোই জানা আছে।”
ফ্রান্সিস ঢাকাঢক করে খানিকটা ওয়াইন গিললো। “জ্বী স্যার। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না।”
“আজ এখানে তোমার উপস্থিতি আমি ভাগ্যের খেল ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছি না; যেনো তোমাকে তোমার কপালই এখানে টেনে নিয়ে এসেছে। এক সপ্তাহ আগে একটা জাহাজ ভারত থেকে ডেপ্টফোর্ডে নোঙ্গর করে। নাম ডাওজার। ক্যাপ্টেনের নাম হচ্ছে ইঞ্চবার্ড। ওর কাছে থেকে সেই একটা ঘটনা শুনলাম আমি। বোম্বে থেকে রওনা দেওয়ার বাইশ দিন পরে, মাদাগাস্কারের কাছাকাছি ওদের জাহাজকে দস্যুরা আক্রমণ করে বসে। ওরা প্রায় দখল করেই ফেলেছিল জাহাজটা। প্রলয়ঙ্কর যুদ্ধ হয় সেদিন। কিন্তু ওরা যখন প্রাণপণ লড়াই করছিলো তখন একটা ছোট জাহাজ ওদের সাথে যোগ দেয়। আর ওটার ক্যাপ্টেন ছিলো আমাদের টম কোর্টনী।”
ফ্রান্সিসের মনে হলো ঘরটা ওর চারপাশে দুলছে। দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলো যেনো ওর দিকে এগিয়ে আসছে, ওয়াইন ওর মাথায় চড়ে বসছে। “এ কিভাবে সম্ভব? টম কোর্টনীতে অনেক আগেই আফ্রিকায় মারা গিয়েছেন। আমার গাই চাচা বলেছেন সেটা।”
“তোমার চাচা ভুল জেনেছিলেন। টম কোর্টনী বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। আফ্রিকার উপকূলে ব্যবসা করে বেড়াচ্ছে। ইঞ্চবার্ডের ধারণা সমুদ্রে না বের হলে সে কেপ টাউনে থাকে।”
চিল্ডস তার কাটা চামচ আর ছুরি নামিয়ে রাখলেন। “তুমি কোম্পানিতে একটা চাকরি চেয়েছিলে। তোমার দাদার জন্যে যে ভালোবাসা আমার আছে, বা তোমার পরিবারের সাথে আমাদের যে দীর্ঘ সম্পর্ক সেটার জন্যে আমি তোমাকে খুশি মনে তোমার গাই চাচার সাথে একটা কেরানির চাকরি দিয়ে দিতে পারি। আমাদের একটা জাহাজে করে তুমি ফ্রি-তেই যেতে পারবে ভারত। কিন্তু আমি তোমাকে এর চাইতে ভালো কিছু দিতে পারি। জাহাজকে বলবো কেপ টাউন হয়ে বোম্বে যেতে। ছোটখাটো মেরামত আর রসদ সংগ্রহ করতে ওখানে কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে। যদি তুমি চাও তো জাহাজ থেকে নেমে তোমার চাচাকে খুঁজে বের করতে পারো।”
ফ্রান্সিস আরো এক টুকরো মাংস গিলে নিলো। এতোগুলো খবরের ধাক্কা সামলাতে কষ্ট হচ্ছে। চিল্ডস সামনে ঝুঁকে এলেন। ওয়াইনের কারণে তার ঠোঁট রক্তের মতো লাল হয়ে আছে।
“টম কোর্টনী যখন ইংল্যান্ড ছেড়ে পালিয়ে যায়, তখন আমরা ওকে ধরার জন্যে পাঁচ হাজার পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করেছিলাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেই পুরস্কারের জিম্মা নিচ্ছি। এখনো সেটা বলবত আছে। পাঁচ হাজার পাউন্ড।” আবার বললেন চিল্ডস। “যে কোনো মানুষের জন্যে বিশাল একটা টাকা, আর তোমার মতো বয়সীর কথা তো ছেড়েই দিলাম। আর টাকাটা যদি তুমি বোম্বেতে ঠিকমতো খাটাতে পারো তাহলে ফিরতে ফিরতে তুমি এটা দ্বিগুণ কি তিনগুণ-ও করে ফেলতে পারবে।”