“এটা আমাদের পরিবারের। আমার বাবা আমাকে এটা দিয়ে গিয়েছেন।”
স্যার নিকোলাস পদকটাকে উলটে পালটে দেখলেন কিছুক্ষণ, তারপর লোকদেরকে হাতের ইশারায় ফ্রান্সিসকে ছেড়ে দিতে বললেন।
“কে তুমি?” স্যার নিকোলাস আবার জিজ্ঞেস করলেন কথাটা। তবে এবার আর তাচ্ছিল্যের ভাবটা নেই।
ফ্রান্সিস সোজা হয়ে দাঁড়ালো। নড়তেই সারা শরীরে অবর্ণনীয় ব্যথা ছড়িয়ে পড়লো। দাঁতে দাঁত চেপে অগ্রাহ্য করলো সেটাকে। এই প্রশ্নটা শুনলে কি বলবে সেই কথাগুলো সারাদিন বার বার আওড়েছে ও। কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতে কথাগুলো বলতে হতে পারে সেটা কল্পনাও করেনি।
“আমি ফ্রান্সিস কোর্টনী, বাবা উইলিয়াম কোর্টনী। আর দাদা হচ্ছেন হাল কোর্টনী। ডার্টমাউথ এর ব্যারন আর অর্ডার অফ সেন্ট জর্জ অ্যান্ড দ্য হলি গ্রেইল এর নৌবাহিনির নাইট। বিশ বছর আগে আমার দাদা আপনার কোম্পানির জাহাজ রক্ষা করতে ফিয়ে জলদস্যুদের সাথে যুদ্ধে নিহত হন। এখন আমি শুধু একটু সহায়তা চাচ্ছি। আমি কোম্পানির চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ চাই।”
চিল্ডস এমনভাবে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন যেনো ও একটা প্রেতাত্মা।
“তোমরা যাও,” নিজের লোকদের আদেশ দিলেন উনি।
ওরা চলে গেলো। চিল্ডস আপাদমস্তক ফ্রান্সিসকে জরিপ করলেন। কয়েক যুগ ধরে উনি নিজের সম্পত্তির মতো করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দেখাশোনা করছেন। এই লেডেনহলের অফিস থেকে শুরু করে পৃথিবীর অপর প্রান্ত পর্যন্ত নিজের হাতকে প্রসারিত করেছেন উনি। কতো রাজা, মন্ত্রী আসলো গেলো। কেউ কেউ দাবি করেছিলো কোম্পানি খুব বেশি ক্ষমতাধর হয়ে যাচ্ছে, এর ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা দরকার। কিন্তু উনি তাদের প্রত্যেককে দেখে নিয়েছেন। একে একে তার প্রত্যেক প্রতিদ্বন্দ্বীকে হটিয়ে দিয়ে আজও টিকে আছেন, আর তাদের চাইতে বেশিদিন বেঁচেও আছেন।
কোর্টনীরাও অনেকেই এসেছে গিয়েছে। পরিবারটা একসময় খুবই ভালো কাজের লোক হিসেবে তাকে সেবা দিয়েছে এবং এই সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। আর কাজ শেষ হওয়ার পর উনি ওনার শত্রুদের মতোই ওদেরকেও সহজেই সরিয়ে দিয়েছেন। এসব করতে ওনার এক ফোঁটা বিবেকে বাঁধেনি। বোম্বেতে ওনার নিজের বাড়িতে বসে উনি টম কোর্টনীকে ওর ভাই উইলিয়ামের হাতে খুন হয়ে যাওয়ার ফাঁদ পাতেন। কিন্তু ওনাকে অবাক করে দিয়ে টম সেই ফাঁদ কেটে বেরিয়ে উল্টো উইলিয়ামকেই মেরে বসে। তবে তাতে চিল্ডসের কোনো সমস্যা হয়নি। টম ফেরারি হয়ে পালিয়ে যায় আর উইলিয়ামের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাত শতাংশ ভাগ চলে যায় ওর শিশুপুত্রের উত্তরাধিকারে। আর এক বিধবাকে ফুসলিয়ে সেই ভাগটা তার কাছে বিক্রি করানোর জন্যে মোটেও কোনো কষ্ট হয়নি। ফলে কোম্পানির উপর তার প্রভাব এখন একচেটিয়া করে ফেলা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু উনি এই ফ্রান্সিস কোর্টনীর কথা একদমই ভুলে গিয়েছিলেন।
ছেলেটা এখন তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, প্রায় যুবক হওয়ার দশা। লোকগুলো ওর গলার যেখানে চেপে ধরেছিলো সেখানে একটা নীলচে দাগ হয়ে আছে। চেহারা ফ্যাকাশে কিন্তু তাতেও একটা চাপা আভিজাত্য ঠিকই প্রকাশ পাচ্ছে, যা চিল্ডস বিশ বছর আগে ওর দাদা হাল-এর মাঝে দেখেছিলেন। এই ছেলেটা তার খুব কাজেও লাগতে পারে, আবার তার জন্যে বিপজ্জনকও হয়ে দাঁড়াতে পারে।
“শোন বাছা,” উনি আগের চাইতে অনেক নরম আর স্নেহময় কণ্ঠে বললেন। “কাছে এসো যাতে তোমাকে আরো ভালো দেখতে পারি।”
উনি ইচ্ছে করে এমনটা করতে বললেন। ওনার শরীর নষ্ট হয়ে গেলেও নীল চোখজোড়া এখনো ওনার মস্তিষ্কের মতোই ক্ষুরধার আছে।
ফ্রান্সিস টলোমলো পায়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলো।
“তোমার সাথে এরকম বাজে আচরণ করার জন্যে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি,” চিল্ডস বললেন। “আমার শত্রুদের গুপ্তচরের অভাব নেই। আরা আমাকে আর আমার কোম্পানির ক্ষতি করতে ওরা কিছুতেই থামবে না। খুব বেশি ব্যথা পাওনি তো, না?”
ফ্রান্সিস ওর হাতের পাশটা একটু ঘষলো। না দেখেও টের পাচ্ছে যে ওসব জায়গায় রক্ত জমাটবেঁধে গিয়েছে।
“আমি খুব ক্ষুধার্ত, মহামান্য।”
“আরে তাইতো।” চিল্ডস ওনার ডেস্কের কোনায় বসানো একটা বেল বাজালেন। তারপর ধমক দিয়ে একজন চাকরকে খাবার আনতে আদেশ দিলেন। “এখন বসো দেখি। আর আমাকে সব খুলে বলো। এখানে এলে কিভাবে? চিঠি লিখে যদি আসতে তাহলেতো তোমাকে এতো ঝামেলা পোহাতে হতো না।”
ফ্রান্সিস ব্যথা সামলে চেয়ারে বসলো। “আমার সৎ বাবা গত সপ্তাহে মারা গিয়েছেন। এই সোনার পদকটা ছাড়া আর কিছুই রেখে যাননি উনি।”
চিল্ডস একটা রুমাল দিয়ে নিজের প্রু মুছলেন। “শুনে খারাপ লাগলো। তোমার মা হয়তো কখনো বলেনি তোমাকে, কিন্তু আমি সবসময়েই তোমার বড় হওয়ার খোঁজখবর রেখেছি। আর তোমার বাবা যেভাবে মারা, গেলেন-আমার নিজেকেও ব্যাপারটার জন্যে দোষী মনে হয়। কারণ তোমার টম চাচা ঐ জঘন্য কাজটা করতে যাওয়ার আগে আমিই ছিলাম শেষ লোক যে তাকে দেখেছিলো। আমার সবসময়েই মনে হয়েছে যে আমি কি কিছু বলে বা করে ওর সিদ্ধান্ত পাল্টাতে পারতাম? আমি কি একটু খেয়াল করলে ওর অভিসন্ধি ধরতে পারতাম আর ওকে আটকাতে পারতাম?”
বলতে বলতে কাশির দমকে বাকা হয়ে গেলেন উনি। রুমাল দিয়ে মুখ চেপে ধরলেন সাথে সাথে। রুমালটা সরাতেই দেখা গেলো ওটায় টকটকে তাজা রক্ত লেগে আছে।