লেগ্রাঞ্জ নিজের জাহাজের দিকে তাকালো এবার। জাহাজটা শুরুতে ব্রিস্টল থেকে দাস আনা নেওয়ার কাজ করতো। পূর্ব আফ্রিকা থেকে আমেরিকার উপনিবেশ আর ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ সব জায়গাতেই চলাচল ছিলো ওটার। লেগ্রাঞ্জ ছিলো এটার ফাস্ট মেট। কিন্তু একদিন চুরি করতে গিয়ে ক্যাপ্টেনের কাছে ধরা পড়ে যায়। ক্যাপ্টেন ওকে পিটিয়ে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেয়। পরদিন রাতে, ক্ষতের ব্যান্ডেজের রক্ত শুকানোর আগেই ও ওর পক্ষের নাবিকদের নিয়ে জাহাজ আক্রমণ করে, আর জাহাজ দখল করে ক্যাপ্টেনকে মাস্তুল-এর কাঠে ঝুলিয়ে দেয়। ওরা জাহাজটাকে একটা জনশূন্য খাড়িতে নিয়ে যায়, তারপর জাহাজটার নাবিকদের থাকার জায়গাটা পুরো ভেঙ্গে ফেলে খোলের দুপাশে এক ডজন বন্দুকের খোপ তৈরি করে নেয়। নিজেদের বিনোদনের জন্যে সুন্দর কয়েকটাকে রেখে স্বাস্থ্যবান দাসগুলোকে বেঁচে দেয় ওরা। দুর্বল আর রোগাগুলোকে হাত পা বেঁধে ফেলে দেওয়া হয় সমুদ্রে। জাহাজের যেসব ক্রু ওদের দলে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায় ওদেরও একই পরিণতি হয়। জাহাজটা আগে শুধু নামেই যোদ্ধা ছিলো, এখন কাজেও হয়েছে। এখন ওটা এমন এক শিকারি যেটা সাগরের বুকের বড় বড় জাহাজগুলো বাদে আর সবকিছুকেই শিকার করতে পারে।
“বো চেজারটা (জাহাজের সামনে বসানো কামান) থেকে গোলা ছোড়ো,” আদেশ দিলো ও। “পাছায় বাড়ি খেয়ে ওটা আর কদ্দূর যেতে পারে দেখা যাক।”
“আর একটা পালও যদি ভোলা হয়, তাহলে ওদের বড় মাস্তুলটা ভেঙ্গে পড়বে,” পাশ থেকে মেট বললো।
লেগ্রাঞ্জ হাসলো। “একদম ঠিক!”
ওর লোকেরা বো চেজারটায় গোলা ভরতে লাগলো। জাহাজের সামনে পিছনে দুই দিকেই আছে কামান। জাহাজের পাটাতন কিছুটা বাড়িয়ে ওগুলো বসানোর জায়গা করা হয়েছে। বত্রিশ পাউন্ডের গোলা ছুঁড়তে পারে কামানগুলো। গোলন্দাজ লোকটা নিচ থেকে একটা ব্রেজিয়ারে (লোহার পাত্র) কয়লা এনে তাতে আগুন ধরিয়ে দিলো। ওরা জাহাজ আর জাহাজের মালপত্র দুটোই চায় কিন্তু যদি শেষ পর্যন্ত হাত ফসকে যায়, তাহলে লেগ্রাঞ্জ দরকার হলে জাহাজটা পুড়িয়ে দেবে তবুও পালাতে দেবে না।
“ওটার কি হবে ক্যাপ্টেন?” মেট জিজ্ঞেস করলো।
জাহাজের পিছন দিকে বহুদূরে দিগন্তের কাছে আরো একটা জাহাজকে : ঢেউয়ের তালে দুলতে দেখা যাচ্ছে। লেগ্রাঞ্জ নিজের পাই গ্লাসটা সেদিকে তাক করলো। জাহাজটা ছোট, এক মাস্তুলের। রোদে পোড়া খোল। বাতাসের তোড়ে প্রায় উড়ে আসছে, মনে হচ্ছে হুমড়ি খেয়ে উল্টে পড়তে পড়তেও পড়ছে না। ওটার লোকজন সব জাহাজের ডেক-এ জড়ো হয়ে ওদের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। একজনের হাতে একটা টেলিস্কোপ দেখা গেলো, ফাইটিং কক-এর দিকে তাক করাপতাকা দেখে সম্ভবত ব্যাটা এতোক্ষণে নিজের পায়জামা ভিজিয়ে ফেলেছে, আর মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছে যে জলদস্যুরা ওদেরকে রেখে আরো দামী একটা জাহাজের পিছু নিয়েছে।
লেগ্রাঞ্জ মুখ টিপে হেসে হাতের টেলিস্কোপটা নামিয়ে রাখলো। “আগে এদের সাথে বোঝাঁপড়াটা করে নেই। তারপর ওটার দিকে নজর দেওয়া যাবে। আপাতত ওটা আমাদের কোনো ঝামেলা করতে পারবে না।”
*
টম কোর্টনী নিজের টেলিস্কোপ নামালো। লাল আর কালো পতাকাওয়ালা জলদস্যুর জাহাজটা দিগন্ত রেখার কাছে ছোট হতে হতে হারিয়ে যাচ্ছে প্রায়।
“মার্চেন্টম্যানটা আরো একটা পাল খাটাচ্ছে,” মন্তব্য করলো ও। “এবার সম্ভবত ওরা ওদেরকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে।”
জলদস্যুর জাহাজ থেকে আলো ঝলসে উঠলো। এক সেকেন্ড পরেই ওরা কামানের গোলার পানির উপর আছড়ে পড়ার মৃদু শব্দ শুনতে পেলো।
“এখনো সীমার বাইরে,” টমের পাশের লোকটা বললো। কামানের গোলার আঘাতে মার্চেন্টম্যানটার পিছনের কয়েক ক্যাবল দূরের পানি ছিটকে উঠেছে শুধু। লোকটা টমের চাইতে লম্বা, গা ভর্তি মাংস, নড়লেই কিলবিল করে। তার কালো মুখ ভরা অনেকগুলো কাটা দাগ, উঁচু নিচু হয়ে আছে। আফ্রিকার যে উপজাতিতে ওর জন্য সেটার শাস্ত্রীয় আচারের চিহ্ন ওগুলো। সেই ছোট থেকে লোকটা টমের সাথে আছে-এর আগে ছিলো টমের বাবা হাল-এর সাথে। অথচ ওর কালো শরীরটায় এখনো একটা ভাজ-ও পড়েনি কিংবা একটা চুলেও সামান্য পাক ধরেনি। যদিও মাথা সবসময়েই কামিয়ে রাখে।
“বেশিক্ষণের জন্যে না, আবোলি। এই মোটা শরীর নিয়ে জাহাজটা আর বড়জোর কয়েক নট পর্যন্ত নিরাপদে থাকবে।”
“ওরা আত্মসমর্পণ করলেই বুদ্ধির কাজ করবে। যারা বাধা দেয়ার চেষ্টা করে তাদেরকে জলদস্যুরা কি করে সেটা তো জানাই আছে।”
টম ওর পিছনদিকে তাকালো। সামনের দিকে টাঙ্গানো শামিয়ানার নিচে দুজন মহিলা বসে আছে। দুজনেই ওদের কথা কান পেতে শুনছে, আর সেটা লুকানোর কোনো চেষ্টাই করছে না।
“তার মানে আমাদের আসলে মার্চেন্টম্যানটাকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই,” অনিশ্চিত স্বরে বললো টম।
আবোলি জানে টমের মাথার ভিতর কি চিন্তা চলছে। “ওদের চল্লিশটা কামান আছে, আর আমাদের বারোটা,” সতর্ক করলো ও। “আর ওদের লোকও কমপক্ষে আমাদের দ্বিগুণ।”
“ওদের সাথে লাগতে যাওয়া চরম বোকামি হবে।”
মহিলাদের দুজনের একজন উঠে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো। তার নীল চোখ ঝকঝক করছে। মহিলাকে ঠিক প্রচলিত অর্থে সুন্দরি বলা যাবে : মুখের কাটা বেশি বড়, চোয়াল শক্ত, আর রোদে থাকতে থাকতে মসৃণ চামড়া তামাটে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু দেখে ভীষণ রকম প্রাণবন্ত মনে হয়, জীবনে ভরপুর। আশপাশের সবাইও সেই শক্তিতে আবিষ্ট হয়ে পড়ে। চেহারাটাও দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত। ফলে প্রথম দেখাতেই টম ওর ভক্ত হয়ে গিয়েছিলো বলা যায়।