*
বাইরের থেকে দেখে যা মনে হয়, ভিতরে আসলে বাড়িটা আরো বেশি বড়। লোকগুলো ফ্রান্সিসকে ধরে একটা লম্বা করিডোরে নিয়ে এলো। লবঙ্গ আর মরিচের গন্ধে ভারি হয়ে আছে জায়গাটা। ওখান থেকে অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো ওরা। ফ্রান্সিস হাসি ঠাট্টা আর আলাপের শব্দ শুনতে পেলো, কিন্তু আশেপাশের সব দরজাই বন্ধ, তাই ওদের শব্দ কেউ শুনতে পেলো না।
লোকগুলো ওকে সবার উপরের তলার একটা বিশাল দরজার সামনে নিয়ে এলো। দরজার হাতলটা পিতলের। দেখতে ঠিক শিকার ধরতে উদ্যত একটা সিংহের মতো। দারোয়ান সম্ভ্রমের সাথে টোকা দিলো। এমনকি দরজা খোলার আগেও কিছুটা ইতস্তত করলো, যেনো কোনো ভয়ঙ্কর জানোয়ারের খাঁচায় ঢুকতে যাচ্ছে।
ভিতরটা অন্ধকার। বাতাসও গরম আর ভ্যাপসা। যেনো একটা কাঁচের ঘর। ফায়ারপ্লেসে ছোট একটু আগুন জ্বলছে। পিছনের দেয়ালের সাথে একটা বিশাল ডেস্ক, তার উপরেও একটা মোমবাতি জ্বলছে, কিন্তু দুটোর আলোয় পর্দায় ঘেরা ঘরটা আলোকিত হচ্ছে না মোটেও। দেয়ালগুলো দেখে মনে হচ্ছে যেনো হেলে পড়ছে। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বিশাল বিশাল সব জাহাজ আর যুদ্ধের ছবি ঝুলানো। গিলটি করা ফ্রেমে বাধাই করা ওগুলোর। বাতাসে কটু গন্ধ, যেন এক টুকরো কাঁচা মাংস বহুদিন ধরে এখানে পড়ে আছে। ফ্রান্সিস অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু কাউকে চোখে পড়লো না। শুধু ডেস্কের পিছনে একটা টিপির মতো দেখা যাচ্ছে, যেনো গাদা করা ময়লা কাপড়ের ভূপ।
ওকে ধরে আনা লোকগুলো ওকে ছেড়ে দিয়ে টুপি খুলে দাঁড়ালো। আচমকা বাধন আলগা হওয়ায় ফ্রান্সিস ভারসাম্য হারিয়ে সামনের দিকে প্রায় উল্টে পড়ে যেতে যেতে সামলালো। তারপর গলায় হাত ডলতে লাগলো।
ডেস্কের পিছনে ভেজা, খড়খড়ে কাশির শব্দ পাওয়া গেলো। তারপরেই টিপিটা নড়তে শুরু করলো। অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতেই ফ্রান্সিস বুঝলো ওটা একটা মানুষ। ঠিকভাবে বললে, বিশাল ভুড়িওয়ালা একটা মানুষ। পরনে রেশমের ড্রেসিং গাউন, আর হাঁটুর উপর একটা কম্বল রাখা। থলথলে থুতনির পিছনে ঘাড় দেখাই যাচ্ছে না। লোকটার মাথা কামানো, কিন্তু ঠিকভাবে না, তাই ইতস্তত সাদা চুলগুলো তুলা গাছের কাটার মতো বের হয়ে আছে। গাল জুড়ে নীল হয়ে ফুটে আছে শিরা-উপশিরা। শুধু তার কোটরে বসে যাওয়া, মাংসের আড়ালে লুকানো চোখগুলোতেই একটু যা জীবনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
“কে তুই?” মাথা না তুলেই জানতে চাইলো লোকটা। ফ্রান্সিস ধারণা। করলো লোকটার সম্ভবত মাথা তোলার শক্তি-ই নেই। অনেক পরে ও জেনেছিলো যে ওর ধারণা অর্ধেক সত্যি। যদি কোনো বিরল উপলক্ষে উনি এই ঘর ছেড়ে বের হতে চাইতেন, তাহলে ওনার চেয়ারের সাথে লাগানো লোহার আংটাগুলো ধরে চেয়ারসমেত তাকে টেনে বাইরে নিয়ে আসা হতো। যখন প্রাকৃতিক কর্ম সারার দরকার হতো তখন নাকি তিনজন লোক তাকে বয়ে নিয়ে যেতো, তারপর কাজ শেষ হলে তারাই শৌচকার্য সেরে দিতো।
একজন প্রহরী এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসের পেটে ঘুষি বসিয়ে দিলো। “স্যার নিকোলাস যখন কিছু জিজ্ঞে করবে তখন চুপ না থেকে কথা বলবি।”
ফ্রান্সিস কথা বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু ঘুষি খেয়ে ওর দম বেরিয়ে গিয়েছে পুরোটা, ফলে কোনো কথাই বেরুলো না।
“কে পাঠিয়েছে তোকে? নরিস আর ওর ডোগেটের লোকজন?”
“কে?” হাফাতে হাফাতে বললো ফ্রান্সিস। এই নামের কাউকে চিনি না। আমি।”
“আমার সাথে চালাকি করার চেষ্টা করিস না ছোঁড়া।” স্যার নিকোলাস মাথাটা সামান্য নাড়তেই আরো একটা ঘুষি পড়লো পেটে। তবে ফ্রান্সিস এবার পেট শক্ত করে রেখেছিলো, তাই আগেরবারের মতো অতোটা জোরে লাগলো না। “সারাদিন আমার বাড়ির উপর নজর রেখেছিস। কার উপর গোয়েন্দাগিরি করছিস?”
“মোটেও না”।
“তোকে কি ঐ ইন্টারলোপারগুলো পাঠিয়েছে নাকি? ওরা কি জানে না আমার ব্যবসা চুরির চেষ্টা করার পরিণাম কি হতে পারে? যদি একবার ধরতে পারি তাহলে সবগুলো জাহাজ পুড়িয়ে দিয়ে ভারতের জেলে পচিয়ে মারবো।”
“প্লীজ,” বলতে গেলে ফ্রান্সিস, কিন্তু কিডনী বরাবর আর একটা ঘুষি পড়ায় থেমে যেতে হলো। “আমি ফ্রান্সিস কোর্টনী। আমার মা আমাকে পাঠিয়েছেন।”
স্যার নিকোলাসের চেহারা রাগে লাল হয়ে গেলো। “ফাজলামি করিস আমার সাথে? স্যার ফ্রান্সিস কোর্টনী কমপক্ষে পঞ্চাশ বছর আগে মারা গিয়েছেন।”
“উনি আমার পরদাদা।” ফ্রান্সিস হন্তদন্ত হয়ে জামার ভিতর থেকে ভেলভেটের ব্যাগটা বের করার চেষ্টা করলো। প্রহরী দেখে ভাবলো ও বোধহয় কোনো অস্ত্র বের করছে। সে ফ্রান্সিসের পায়ে লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে মাটিতে ফেলে দিলো, সাথে সাথে আবার পা তুললো ওর বুকে লাথি মারার জন্যে।
ফ্রান্সিস ব্যাগটা বের করে আনলো। প্রহরী ওর হাত থেকে সেটা ছিনিয়ে নিয়ে, মুখটা খুলে ঝাঁকি দিতেই ভিতর থেকে সিংহখচিত পদকটা মেঝেতে গিয়ে পড়লো।
প্রহরী মারার জন্যে আবার হাত তুললো।
“থামো,” স্যার নিকোলাস বললেন। “দেখি আমি ওটা।”
লোক দুজন ফ্রান্সিসকে টেনে তুললো, আর একজন খানসামা সোনার সিংহটা তুলে নিয়ে ডেস্কের উপর রাখলো। স্যার নিকোলাস ওটা তুলে ধরলেন, মোমের আলোয় ওটায় খোদাই করা চুনি আর হীরাগুলো ঝিকিয়ে উঠলো।
“কোথায় পেয়েছিস এটা?” ফ্রান্সিসকে ধমক দিয়ে জানতে চাইলেন উনি।