“মহামান্য গভর্নর কারো সাথে দেখা করেন না,” দারোয়ান জানালো।
“আমি গভর্নরের সাথে কথা বলতে আসিনি, আমার বাবার সাথে দেখা করতে এসেছি।”
দারোয়ান হাঁ হয়ে গেলো। মুহূর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে গেলো চেহারা। “মাস্টার ক্রিস্টোফার?”
“মিস্টার কোর্টনী।”
দারোয়ান তালা খুলতে হিমশিম খেয়ে গেলো। “অবশ্যই স্যার, আমরা আসলে ভেবেছিলাম…
“ভুল ভেবেছিলেন।”
দুই বছর আগে যে নধর কিশোর দুর্গ ছেড়েছিলো তার সাথে ক্রিস্টোফারকে এখন মেলানো অসম্ভব। এখন তার উপর ওর চেহারা রোদে পুড়ে কয়লা, চেহারা ভেঙে চুরে একাকার, একটা হাত নেই। ভিতরের চত্বরটা পেরিয়ে লম্বা পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে গভর্নরের অফিসে উঠে এলো ও। এতোটা আত্মবিশ্বাসের সাথে যে দরজার প্রহরী ওকে আটকাতে ভুলে গেলো। দরজা পার হয়ে আসার পরে সম্বিত ফিরলো প্রহরীর। ক্রিস্টোফার প্রহরী বা পিছনে আগুয়ান চিৎকার কোনোটাকেই পাত্তা দিলো না। সোজা উপরের তলায় চলে এলো।
“ক্রিস্টোফার কোর্টনী,” গাই-এর অফিসের বাইরের প্রহরীটাকে চিৎকার করে জানালো ও। “আমার বাবার সাথে দেখা করবো আমি। আটকালে তোকে আমি চাবুক মারার ব্যবস্থা করবো।”
দরজা খুলে যেতেই ক্রিস্টোফার ঢুকে গেলো বিশাল অফিসটায়। নতুন করে লাগানো জানালা থেকে রঙের গন্ধ আসছে; স্যার হাল কোর্টনীর ছবিটা কিছুটা বাঁকা হয়ে ঝুলছে। দেয়ালের কাঠের গায়ে পাউডারের দাগ দেখা গেলো, ওটার খুব কাছ থেকে পিস্তল ছুঁড়েছিলো কেউ।
করিডোরে হট্টগোলের আওয়াজ পেয়ে গাই নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়েছিলো। ওই অবস্থাতেই ক্রিস্টোফারের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো। ওর কলমের মাথা চুঁইয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় কালি জমতে লাগলো নিচের খাতার উপর।
“তুমি কি…?” নিজে নিজে বিড়বিড় করলো গাই।
তারপরই সামলে নিলো নিজেকে। চোয়াল বন্ধ হয়ে চেহারা আবার শক্ত হয়ে গেলো। শীতল একটা হাসি হাসলো ও।
“উড়নচণ্ডী ছেলেটা বাড়ি ফিরেছে দেখি। হাহ! তোমার মা অন্তত এখন খুশি হবে।”
ক্রিস্টোফার মাথা ঝাঁকালো।
“তো?” ধমকের সুরে বললো গাই। “কি মনে করে এসেছো আবার? এখন কি তোমার নামে মেজবান দেবো নাকি?”
“ওসব লাগবে না। আমার নিজেরই অনেক টাকা আছে।”
ক্রিস্টোফার নিজের মুঠি খুলে একগাদা উজ্জ্বল ঝকমকে হীরে দেখালো। গাই ওটার দিকে এক নজর দেখে নাক সিটকালো।
“এসব পাথরের টুকরো দেখেই পটে যাবো ভেবেছো? তুমি হয়েছে। বড়লোক? ধন সম্পদ কি সেটাই তো বোঝো না।”
“রুথকে বিয়ে করার মতো টাকা পয়সা হয়েছে আমার।”
“কে?”
“রুথ। কর্পোরাল রেড্ডির মেয়ে।”
এরপরেও গাই-এর এক মুহূর্ত লাগলো বুঝতে। তারপর মাথাটা পিছনে হেলিয়ে এতো জোরে হো হো করে হেসে উঠলো যে জানালার পর্দাগুলো পর্যন্ত কেঁপে উঠলো। “রুথ রেডিড? এতোদিন পরেও তুমি ঐ মাগীটাকে মনে রেখেছো?”
“আমি ওকে বিয়ে করবো।”
“আমার তা মনে হয় না।”
ক্রিস্টোফার হাতের ভিতর লুডুর ঘুটির মতো করে হীরাগুলো নাড়তে লাগলো। আমি এখন একজন ধনী লোক। আমাকে তুমি আটকাতে পারবে না।”
“আমি তোমাকে আটকাতেও চাই না,” খুশি উপচে পড়ছে গাই-এর চেহারায়। “তোমার বিয়েতে আমার দোয়া রইলো। কিন্তু সমস্যা একটাই-” বলতে বলতে আবার হাসিতে ভেঙে পড়লো ও। “তোমার পেয়ারি বিয়ে করে ফেলেছে।”
ক্রিস্টোফারের মনে হলো ওর পায়ের নিচে যেনো মাটি নেই। “কি?”
“তুমি যাওয়ার পরপরই ও বিয়ে করে ফেলে। জাহাজঘাটের এক কুলিকে। একটা বাচ্চাও আছে এখন। আমার বিশ্বাস সুখে শান্তিতেই আছে ওরা। যদিও…” বলে ও ক্রিস্টোফারের হাতের হীরা গুলির দিকে ইংগিত করলো। “এখন যদি এগুলো দেখে তাহলে এতো তাড়াহুড়ার জন্যে আফসোস করবে নিশ্চিত।”
ক্রিস্টোফার অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে। এটা মিথ্যা নিশ্চিত। গাই নিশ্চয়ই ওকে কষ্ট দিতে বানিয়ে বানিয়ে মজা করছে। রুথ কখনোই ওর সাথে ধোকাবাজি করবে না।
কিন্তু গাই-এর আনন্দ একদম খাঁটি। ক্রিস্টোফার ওর বাবার চোখের দিকে তাকালো। তাকিয়েই বুঝলো সে সত্যিটাই বলছে। আবারও জিতে গেলো গাই।
রাগে চোটে ও হীরাগুলো মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললো। মেঝেতে লাফিয়ে ঘরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়লো ওগুলো। লাফানো থামার আগেই ক্রিস্টোফার দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। ওর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিছু ভাবতে পারছে না আর। বহুদিনের লালিত স্বপ্ন, ও গাইকে এক হাত নেবে, কিন্তু আবারও নিজের বাবার কাছে পরাজিত হলো।
“দাঁড়াও।”
ক্রিস্টোফার যতো বড়ই হোক, ঠিক সেই ছোট বেলার মতো করেই গাই এর আদেশ ওর মগজের অভ্যন্তরে ভীতির সৃষ্টি করলো। দাঁড়িয়ে গেলো সাথে সাথেই। ক্রিস্টোফার ঘুরলো। গাই ওর চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে এলো ওর দিকে। এক হাত দুরত্বে দাঁড়িয়ে আছে ওরা দুজন এখন। দুজনেরই নিঃশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন। যেনো মুখোমুখি দুই মুষ্টিযোদ্ধা।
“আমি জানি মেয়েটাকে খুব পছন্দ করতে তুমি,” গাই বললো। এক মুহূর্তের জন্যে গাইকে খুব অমায়িক একজন লোক মনে হলো। “কিন্তু ওকে আর আমাদের মাঝে আসতে দিও না। তুমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে নিজে বুনো ওল লাগিয়ে খেতে চেয়েছ, তা করতে গিয়ে আঘাত প্রত্যাঘাতও পেয়েছে ভালোই। এখন নিজের পরিবারের, নিজের জায়গায় ফিরে এসো।”