টম সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষণ, ক্রিস্টোফার আবার ভেসে ওঠে কিনা সেটা দেখার আশায়। এতে উপর থেকে পড়ার পরেও কি বেঁচে থাকা সম্ভব? নাকি নিচে পাথরে লেগে ওর শরীরটা কি ভর্তা হয়ে গিয়েছে?
চিন্তাটা মাথায় আসতেই শিউরে উঠলো ও। রক্তে লড়াইয়ের উত্তাপ জমে গেলো মুহূর্তেই। কেনো যেনো বিজয় অনুভব করতে পারছে না ও, এক শোচনীয় পরাজয়ের অনুভূতি সারা দেহ জুড়ে।
আমার ছেলে, ভাবলো ও। আর আমি ওকে বাঁচাতে পারলাম না। ঠিক যেভাবে বিলিকেও বাঁচাতে পারিনি।
চোখের কোনা দিয়ে নেপচুন তরবারিটাকে ঝিকিয়ে উঠতে দেখলো টম। হাতলে তখনও ক্রিস্টোফারের কাটা আঙুল মুঠো করে ধরে আছে। টম একটা একটা করে খুলে আনলো সেগুলো। এমনকি মরে গিয়েও ওগুলো তরবারিটা ছাড়তে রাজি না। দগদগে মাংস দেখে বমি পেলো ওর। কি করেছে সেটা দেখে আর সহ্য করতে পারছিলো না। তারপর কি মনে হতে তরবারিটাকে ছদের কিনারের দিকে ছুঁড়ে দিলো।
ও তরবারিটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। সকালের রোদে ঝকমক করছে। একটুর জন্যে ক্রিস্টোফারের মতো ছাদ থেকে সমুদের গিয়ে পড়েনি। নীলাটা মিটিমিট করে জ্বলতে জ্বলতে যেনো ওকে ভেংচি কাটছে। তরবারিটা কি একজন মানুষের জীবনের চাইতেও মূল্যবান? ওর সন্তানের জীবনের চাইতেও?
কিন্তু আজ এক নতুন সূর্য উদিত হয়েছে, নতুন করে জীবনের সূচনা হয়েছে। দিগন্তের দিকে তাকিয়ে টমের সারাহকে বলা কয়েকটা কথা মনে পড়লো। “একজন মানুষের মানুষ হওয়ার পিছনে কি থাকে?” জানতে চেয়েছিলো টম। আর সারাহ জবাব দিয়েছিলো, “মানুষ যে গুণাবলিই পাক বা কারো কাছ থেকে যা কিছুই শিখুক-সে সবার চাইতে আলাদা একটা মানুষ হবে। তুমি শুধু ওকে সঠিক পথটা চিনিয়ে দিতে পারো। সঠিক পথে না হাঁটলে সেটা তোমার দায় না।”
ক্রিস্টোফার ওর নিজের রাস্তা বেছে নিয়েছিলো, ঠিক যেমন বহু বছর আগে নিয়েছিলো বিলি। একটা পরিবার হচ্ছে একটা জ্যান্ত আর অশান্ত জিনিসের মতো। আর অন্যসব জ্যান্ত জিনিসের মতোই, এটা কখনো নিজের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে না। টম যা করেছে তা শুধু নিজেকে বাঁচাতে।
ও তরবারিটা তুলে নিয়ে নিচে নিজের পরিবারের কাছে ছুটে গেলো।
*
সারাহ আর অ্যাগনেস তখনও কয়েদখানাতেই আছে। এতোদিনের বন্দীদশা ছেড়ে আজ ওরা মুক্ত। কিন্তু আরো বেশি রক্তপাতের ভয়ে সারাহকে এখনই এখান থেকে সরাতে চায়নি অ্যাগনেস। টম ওদেরকে তাজা বাতাস আর পরিষ্কার কামরায় নিয়ে যেত চাচ্ছিলো, কিন্তু অ্যাগনেসের কথাটা যুক্তিযুক্ত হওয়ায় চুপ করে গেলো। আর এখন যেহেতু প্রতিটা দস্যুকেই ধরে আনা হয়েছে, তাই কয়েদখানাও অন্য যে কোনো জায়গার মতো নিরাপদ।
অ্যানাও চলে এসেছে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে শাহুজির শিবিরে আর এক মুহূর্তও দেরি করেনি। সাথে করে খাবারও নিয়ে এসেছে। এসে ফ্রান্সিসের ক্ষতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে। সারাহকেও কি একটা মলম লাগিয়ে দিয়েছে, জায়গাটা তাড়াতাড়ি শুকানোর জন্য। এখন ও আর ফ্রান্সিস দুজন দুজনের কাঁধে হাত দিয়ে একসাথে বসে আছে, অবাক চোখে বাচ্চাটাকে দেখছে। ওদের চেহারার ভাব দেখে, ওদের আলিঙ্গনের শক্তি দেখে টম বুঝলো যে ওর দাদা হতে খুব বেশি দিন লাগবে না।
আশেপাশের জীবন মৃত্যুর খেলার সবকিছু ভুলে বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে, এখনো ওর নাড়ীটা কাটা হয়নি। অ্যাগনেসের পাশে মেঝেতে পড়ে থাকা রক্তপিণ্ডের সাথে তখনও আটকে আছে।
“এটা কেটে দিলে ভালো হতো না?” অনিশ্চিত সুরে জিজ্ঞেস করলো টম।
“আমরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম,” অ্যাগনেস বললো।
টম নিজের বেল্টের নেপচুন তরবারিটায় হাত দিলো। কিন্তু এরকম পবিত্র একটা তরবারি বাচ্চা প্রসবের মতো অশুচি কাজে ব্যবহার বা এরকম একটা প্রাণঘাতী অস্ত্র একটা নিষ্পাপ বাচ্চার কাছে আনার কোনোটাতেই টমের ইচ্ছে করছিলো না।
কিন্তু বাচ্চাটা টমের উত্তরাধিকারি। তরবারিটা কোর্টনীদের ঐতিহ্য, আর একদিন এই ছোট্ট বাচ্চাটাই বড় হয়ে তরবারিটা চালাবে। টম প্রথমে ফলাটা মুছে একেবারে চকচকে বানিয়ে ফেললো। অ্যাগনেস দুই হাত দিয়ে চটচটে নাড়ীটা ধরে কোথায় কাটতে হবে দেখিয়ে দিলো। ধারালো প্রান্তটা এক টানে কেটে ফেললো সেটাকে। টম শেষ প্রান্তটা বেধে দিয়ে বাচ্চাটার কপালে চুমু খেলো। ও ভবিষ্যতে কি হবে? কেমন মানুষ হিসেবে বড় হবে ও?
তুমি শুধু ওকে সঠিক পথটা চিনিয়ে দিতে পারো।
“কি নামে ডাকবো ওকে আমরা?” টম জিজ্ঞেস করলো।
সারাহ অ্যাগনেসের দিকে তাকালো। ওর বোন এই ভয়াবহ দীর্ঘ গর্ভধারণের সময়টায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে ওর যত্ন নিয়েছে। নিজেও কতোটা যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে গিয়েছে কিন্তু একটা বারের জন্যে অভিযোগ করেনি।
“ওর নাম হচ্ছে জেমস,” সারাহ বললো। “ক্যাপ্টেন হিকসের নামানুসারে রাখলাম নামটা।”
অ্যাগনেসে চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে এলো। সারাহ সামনে ঝুঁকে এলো যাতে অ্যাগনেস নিজেকে সামলে নিতে পারে। ও বাচ্চাটার দিকে তাকালো। ছোট্ট পেটটা থেকে তখনও নাড়ির সামান্য অংশটা বেরিয়ে আছে।
“টম কোর্টনী,” ঢুলুঢুলু কণ্ঠে বললো সারাহ। “তুমি দেখি ছেলের নাড়িতে পাল খাটানোর গিট্টু মেরেছে।”
*
বোম্বের দুর্গটার ফটকের দারোয়ান সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে চিনলো না। টাক মাথা, গাড় বাদামি রঙের চামড়া দেখে মনে হতে পারে যে লোকটা একটা উচ্চ বর্ণের পার্সি। এরা কোম্পানির ব্যবসার উপর খেয়ে পরে বেঁচে থাকে। কিন্তু এর গায়ের পোশাক ইউরোপিয়ান। গায়ে চমৎকার কাপড়ের লাল রঙা কোট, পরনে সাদা ধবধবে পায়জামা। একটা হাত জামার হাতার ভিতরে ঢোকানো, তবে অন্যটা মুঠো পাকিয়ে আছে।