টম দুই হাত সামনে বাড়িয়ে ডাকলো, “বাবা আমার।”
“বাবা।”
ক্রিস্টোফার টমকে ওর দিকে দুই কদম এগিয়ে আসতে দিলো। তারপর তরবারিটা তুলে ঝাঁপিয়ে পড়লো আবার।
ছাদের একদম কিনারে দাঁড়িয়ে থাকায় টমের পিছিয়ে যাওয়ার উপায় ছিলো না। কিন্তু ও পুরোপুরি অপ্রস্তুত-ও ছিলো না। ক্রিস্টোফারকে ক্ষমা করেছে ঠিক আছে, কিন্তু এখনো ওকে বিশ্বাস করা শুরু করেনি। ক্রিস্টোফারের চোখের হিংস্র দৃষ্টি ওর চোখ এড়ায়নি। ক্রিস্টোফার তরবারি নামিয়ে আনার এক সেকেন্ড আগেই ও খেয়াল করলো ব্যাপারটা। একপাশে সরে গিয়ে আঘাতটা এড়িয়ে নিজের তরবারিটা উপরে তুলে ক্রিস্টোফারের তরবারি ডানপাশে সরিয়ে দিলো। দুটো তরবারি বাড়ি খেয়ে ঝনঝনিয়ে উঠলো। মিনারের উপরে এই নীরব জায়গায় আরো জোরালো শোনালো সেটা। ক্রিস্টোফার তরবারি তুলে আবার আক্রমণ করলো। আবার দুই ফলা একসাথে আটকে থাকলো কিছুক্ষণ। টম আর ক্রিস্টোফার দুজনই দুজনকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। পুরোপুরি শক্তির খেলা চলছে। কেউই তরবারি ছোটাতে সাহস করছে না, কারণ তাতে অন্যজন তরবারি চালানোর সুযোগ পেয়ে যাবে।
আচমকা ক্রিস্টোফার পিছন দিকে লাফিয়ে সরে গেলো, যাতে টম ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। টম সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়লো, নিচে নামার সিঁড়ির মুখের চৌকো দরজাটায় পা প্রায় ঢুকেই গিয়েছিলো। ও পা সরিয়ে নিতে গিয়ে কাত হয়ে গেলো একপাশে। তারপর সেদিক দিয়ে নিচে পড়তে পড়তেও সামলে নিলো আবার। ক্রিস্টোফার লাথি চালালো সেদিকে। কিন্তু টম সাথে সাথে পিছিয়ে যাওয়ায় লাগলো না লাথিটা। টম মাটিতে শুয়ে পড়ে, সাথে সাথে পাশে গড়িয়ে আবার উঠে দাঁড়ালো-একটুর জন্যে ক্রিস্টোফারের আঘাতটা ঠেকিয়ে দিতে পারলো ও। নিচু করে উরু বরাবর মেরেছিলো কোপটা।
এরপর দুজন দুজনকে ঘিরে চক্রাকারে ঘুরতে লাগলো। ক্রিস্টোফার আক্রমণ করলো, টম ঠেকালো, কিন্তু কারো ভঙ্গিতেই কোনো তেজ নেই। মুখে মুখে তর্ক চলতে লাগলো, দুজনেই অপেক্ষা করছে একটা মোক্ষম সুযোগের।
ক্রিস্টোফারের মাথায় অবশ্য অন্য একটা চিন্তা চলছিলো। ওর বয়স মাত্র বিশ, আর সারা রাত কিছুই করেনি বলা চলে; আর টম চল্লিশ ছাড়িয়েছে–বিগত কয়েক ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ করছে ও। যতোই ক্রিস্টোফার ওকে কম আক্রমণ করে বিশ্রামের সুযোগ দিচ্ছে, ততোই ওর ভিতরের যুদ্ধের স্পৃহাটা ধীরে ধীরে কমে আসছে। টম নিজেও টের পেলো যে ওর মনোবল কমে আসছে।
ব্যাপারটা আরো ক্ষেপিয়ে দিলো ওকে। নতুন উদ্দীপনা নিয়ে ও আক্রমণ চালালো, দুই হাতে ধরে আছে তরবারিটা। জোর করে সমস্ত শক্তি দুই হাতে জড় করে সমানে ক্রিস্টোফারের দিকে তরবারি চালাতে লাগলো।
কিন্তু ওর ইচ্ছাশক্তি ব্যাপক হলেও শরীরে কুলালো না। যতো জোরে ও চেষ্টা করলো, ওর হাত ততো ধীরে সাড়া দিতে লাগলো। ক্লান্ত হয়ে পড়ছে ও। ঘন ঘন এলোমেলো শ্বাস নিচ্ছে। ক্রিস্টোফার পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে পিছনে হেলে পড়ে টমের আক্রমণ ঠেকিয়ে দিলো, ওর মুখে বিজয়ীর হাসি। ধীরে ধীরে টমকে তার শরীরের সব শক্তি নিঃশেষ করে ফেলতে দিচ্ছে। সব শেষে একটা কোবরার মতো করে ও আঘাত করবে।
কিন্তু সময়টা ক্রিস্টোফারের পক্ষে নেই। চৌকো দরজাটা দিয়ে দুর্গের সিঁড়িতে লোকজনের চিৎকার শোনা গেলো। ইংরেজ কণ্ঠ-ফ্রান্সিস বা মেরিডিউ ওকে খুঁজতে আসছে।
“এসব পাগলামি বাদ দাও,” টম বললো। “তুমি জিততে পারবে না।”
ক্রিস্টোফার ওর দিকে নিখাদ শয়তানের মতো একটা চাহনী দিলো। “হয়তো, কিন্তু আমি নিজের প্রতিশোধ তো নিতে পারবো।”
“তাতে কি লাভ হবে তোমার?”
ক্রিস্টোফার শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। উত্তর জানা নেই ওর। তারপর ক্রুদ্ধ গর্জন ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো আবার। তরবারি সোজা টমের বুক বরাবর ধরে রেখেছে। টম নিজের তরবারি দিয়ে ওটা সরানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে।
নেপচুন তরবারিটা টমের বাম কাঁধ ভেদ করে চলে গেলো। একই মুহূর্তে, টমের আঘাতটাও লাগলো। তবে সেটা টমের নিশানা মতো ক্রিস্টোফারের তরবারির ফলায় লাগলো না, লাগলো তরবারি ধরা হাতের কবজিতে। তরবারিটা ভারী, তার উপর টম সমস্ত শক্তি দিয়ে চালিয়েছিলো কোপটা। মাংস, পেশিতন্ত্র আর হাড় ভেদ করে ওপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলো তরবারিটা।
ক্রিস্টোফার আর্তনাদ করে উঠলো। নেপচুন তরবারিটা পড়ে গেলো ছাদের মেঝেতে। হাতলে ক্রিস্টোফারের কাটা হাতটা আটকে আছে। ক্রিস্টোফার পিছিয়ে গেলো, কবজি পেটের সাথে চেপে রেখেছে। রক্তপাত বন্ধ করতে চাচ্ছে। কিন্তু তবুও ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়েই যাচ্ছে।
টমেরও কাঁধ থেকে রক্ত পড়ছে। কিন্তু ওর আঘাতটা মারাত্মক না। ও নেপচুন তরবারিটা পা দিয়ে চেপে ধরলো। কিন্তু তবুও ক্রিস্টোফার ভালো হাতটা দিয়ে ওটা টেনে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো।
“সব শেষ,” টম বললো।
ক্রিস্টোফার ছাদের কিনারে উঠে দাঁড়ালো। নিচে তাকাতেই মাথা ঘুরে উঠলো ওর; রক্তপাতের কারণে মনে হচ্ছে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। নিচে সবুজ দরিয়া পাথরের চারপাশ ঢেউ তুলে আছড়ে পড়ছে।
“বিদায়, বাবা।”
একদম শেষ মুহূর্তে টম বুঝতে পারলো ক্রিস্টোফার কি করতে যাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে ক্রিস্টোফারকে ধরতে গেলো ও, নিজের কি হবে সে খেয়লা ছিলো না। কিন্তু দেরি করে ফেললো। ক্রিস্টোফার বাতাসে ঝাঁপ দিয়ে নিচে পড়ে গেলো। টমের মনে হল যেনো অনন্তকাল ধরে ওকে পড়তেই দেখছে। তারপর একসময় নিচের ফেনিল সাগরে সামান্য আলোড়ন তুলে হারিয়ে গেলো পানির নিচে।