সিঁড়ির গায়ের একটা দরজায় পৌঁছে থমকে দাঁড়ালো টম। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো ভিতরে কেউ আছে কিনা। একজন পুরুষ আর একজন মহিলার কণ্ঠ শুনতে পেলো অন্য প্রান্তে। খুব তাড়াহুড়া করে দুজনে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে।
টম লাথি মেরে দরজাটা খুলে ফেললো। ভিতরে ঢুকতেই একজন মহিলা চিৎকার দিয়ে উঠে নিজের জামাটা বুকের সাথে চেপে ধরলো। মহিলা নগ্ন, তবে মাত্রই কাপড় পরা শুরু করেছিলো। এরকম অদ্ভুত পরিস্থিতিতেও মহিলাকে চেনা চেনা লাগলো টমের। সামান্য পরেই নামটা মনে পড়লো ওর, লিডিয়া ফয়। তবে মুহূর্তেই ওর অস্তিত্ব মুছে গেলো টমের মাথা থেকে, কারণ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কোমরে একটা ভারী বেল্ট বাঁধছে ক্রিস্টোফার।
টম ওর দিকে ধেয়ে গেলো। লিডিয়া চিৎকার দিয়ে উঠলো আবার। কিন্তু কালারিতে নিবিড় পরিচর্যা পাওয়ার কারণে মুহূর্তের ভগ্নাংশের মাঝে ক্রিস্টোফার নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলতে পারে। ও নেপচুন তরবারিটা তুলে নিয়ে একপাশে সরে গেলো। একই সাথে সেটা দিয়ে টমের তরবারিতে এতো জোরে বাড়ি দিলো যে, টমের হাত থেকে তরবারি প্রায় ছুটেই গেলো। টম ঘুরে সোজা হয়ে আবার তরবারি সোজা করে দাঁড়ালো।
ক্রিস্টোফার সামনে বাড়ার ভান করলো, তারপরেই ঘুরে সিঁড়ির দিকে দৌড় দিলো। ওর জন্যে নিচে নামা নিরাপদ না-কারণ টম যদি ওকে ধরে। ফেলে, তাহলে একটা লাথি মেরেই ওকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে ফেলে দিতে পারবে। তাতে ঘাড় ভেঙে মারা যেতে পারে ও। তাই ও উপরে উঠতে লাগলো। একদম সিঁড়ির মাথা পৌঁছে, ওখানকার ছোট দরজাটা কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে খুলে দুর্গের ছাদে উঠে এলো। কিন্তু দরজাটা বন্ধ করার আগেই উঠে এলো টম।
এবার মিনারের ছাদে মুখোমুখি হলো দুজন। ক্রিস্টোফার দাঁতে দাঁত চাপলো। টম সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছে, আর নিচে যাওয়ার আর কোনো রাস্তা নেই। এসপার নাহয় ওসপার কিছু একটা হবেই এখন।
“আমাকে যদি মেরেই ফেলবেন, তাহলে আমাকে জন্ম না দেয়াটাই ভালো হতো না,” চিবিয়ে চিবিয়ে বললো ক্রিস্টোফার। ভিতরে আক্রোশ দানা বাঁধছে। গাই-এর নিষ্ঠুরতা, ওর মায়ের নীরবতা, যাদেরকে যাদেরকে খুন করেছে-আর সবার আগে ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা-সব চিন্তা মাথায় ঘুরছে ওর। বুঝতে পারছে না ওর কি ওনাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরা উচিত হবে, নাকি তরবারিটা বুকে ঢুকিয়ে দেওয়া উচিত হবে।
তৃতীয় নিয়মটা কি? অতীতের একটা কণ্ঠ ওর মাথায় ডেকে গেলো।
আত্ম নিয়ন্ত্রণ।
ক্রিস্টোফার জোর করে আবেগকে সরিয়ে রাখলো। শুধু হাতের তরবারিটা বাদে আর কিছুকেই ও অনুভব করতে চায় না।
“আমি তোমাকে মারতে চাই না,” টম বললো। ও মন থেকেই বলেছে কথাটা। দিগন্তে সূর্য উঠছে, ভোরের ঝিরিঝিরি বাতাস ওর কানে গুনগুন করে উড়ে যাচ্ছে। টম টের পাচ্ছে যে নতুন একটা দিন নতুন আশার বার্তা নিয়ে শুরু হচ্ছে। “তুমি যদি আসলেই আমার ছেলে হও। তাহলে তুমি যা-ই করে থাকো না কেন, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিতে পারবো।”
‘আমাকে ক্ষমা করে দেবেন?” অবিশ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করলো ক্রিস্টোফার। “আপনার তো হাঁটু মুড়ে বসে আমার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। এই সব কিছুর জন্যে আপনি দায়ী। আপনি যদি আমার মাকে ছেড়ে না যেতেন…”
আবারও আবেগ ক্রিস্টোফারকে কাবু করে ফেলতে চাইলো। ও সেটাকে সরিয়ে দিলো আবার।
“আমি জানতামই না যে ক্যারোলিনের পেটে বাচ্চা ছিলো,” টম প্রতিবাদ করলো।
“কারণ আপনি কোনো পরোয়া করতেন না।” বলতে বলতে ক্রিস্টোফার এগিয়ে এসে প্রচণ্ড আক্রোশে তরবারি চালাতে লাগলো। টম সেটা আটকাতে গিয়ে ছাদের কিনারে চলে এলো। “মজা যা করার করে নিয়ে আপনি নিজের রাস্তায় ভেগে গিয়েছিলেন। যেনো সে একটা বন্দরের মাগী। আমার মা!”
“আমার কিছুই করার ছিলো না।” ক্রিস্টোফারের আঘাতগুলো ঠেকাতে ঠেকাতে বললো টম। কিন্তু হাতে এই অনভ্যস্ত অস্ত্রটা থাকায় ঠিকভাবে ঠেকাতে বা আক্রমণ করতে কোনোটাই পারছিলো না। আর এর বিপরীতে নেপচুন তরবারিটা যেনো বাতাসে নেচে বেড়াতে লাগলো।
“আমি দুঃখিত,” টম বললো। এটাও ও একেবারে হৃদয়ের অকুস্থল থেকে বললো। ওর অবস্থান থেকে তাকালে ও স্পষ্ট দেখতে পায় ওদের জীবনটা কতো ঘটনা-দুর্ঘটনা, সেই সাথে অসংখ্য সুযোগ, সম্ভাবনা, সত্যি-মিথ্যে পেরিয়ে আজ এই অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। যদি ভাগ্যই ওদেরকে এখানে টেনে এনে থাকে তাহলে নিশ্চিত তা কোনো না কোনো প্রয়োজনেই এনেছে।
“এখানে কেন এসেছেন?” ক্রিস্টোফার জানতে চাইলো। “আমাকে পালাতে দিচ্ছেন না কেনো?”
“তরবারিটার জন্যে,” সত্যিটাই বললো টম।
ক্রিস্টোফার শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো ওটা। চেহারা দেখেই বোঝা গেলো জীবনেও মানবে না ও। “এটা আমার।”
টম ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর তরবারিটার সোনালি ফলাটার দিকে তাকালো। ওটার বিশাল নীলাটায় সূর্যের আলো পড়ে ঝিকমিক করছে। একটা নিখুঁত অস্ত্র। ওর বাবার কাছ থেকে পাওয়া উত্তরাধিকার, কোর্টনী পরিবারের সম্মান।
কিন্তু নিজের ছেলের প্রতি ভালোবাসার কাছে একটা তরবারির আর কি দাম থাকতে পারে?
“রেখে দাও,” টম বললো। “যদি এটা দিয়ে আমরা আবার এক হতে পারি, তাহলে ওটা তোমারই থাক।”
ক্রিস্টোফার হাসলো। টম টের পেলো ওর ভিতর একই সাথে পরম একটা স্বস্তি আর স্নেহের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। ক্রিস্টোফার যা-ই করে থাকুক, যে অশুভ কার্যকলাপই ওকে এখানে টেনে আনুক না কেনোটম ওকে ক্ষমা করার একষ্টা রাস্তা বের করেই ফেলবে।