“স্যার নিকোলাস কারো সাথে দেখা করছেন না।” জোর দেওয়ার জন্যে দারোয়ান প্রতিটা শব্দ বলার সময় আঙুল দিয়ে ফ্রান্সিসের বুকে খোঁচা দিলো। “আর যদি আপনি এরকম দরজা ধাক্কা দিতে আসেন তাহলে আপনার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক অনুপ্রবেশের অভিযোগ আনবো।”
ফ্রান্সিস রাস্তার উল্টোপাশে একটা কফির দোকানের ছায়ায় এসে দাঁড়ালো। জানালা দিয়ে দেখতে পেলো লোকজন টেবিল ঘিরে বসে নানা আলাপ আলোচনা করছে, পত্রিকা পড়ছে আর ফাঁকে ফাঁকে ধূমায়িত কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। ওর আর ওদের মাঝে বাধা শুধু একটা কাঁচ, অথচ মনে হচ্ছে ওটা সম্পূর্ণ অন্য একটা দুনিয়া।
একটা অক্ষম ক্রোধ বয়ে গেলো ফ্রান্সিসের ভিতর দিয়ে। একেবারে ভিতরটা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিলো সেটা। বিগত কয়েক বছরে ওর মাঝে মাঝে মনে হতো যে ওর আসলে কিছুই নেই। আসলে ফ্রান্সিস কখনো বোঝেইনি যে ওর কতোটা ছিলো। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছে টাকা পয়সা না থাকার হতাশায় আসলে ও কতোটা কাবু হয়ে পড়েছে। টাকা ছাড়া কিছুই সম্ভব না। এটার কমতি থাকাতেই ওর সৎ বাবা মারা পড়লো, ওকে ওর মায়ের কাছে থেকে আলাদা হয়ে যেতে হলো, ওর বাড়ি, ওর ঘোড়া সব ছাড়তে হলো। পরনের কাপড় আর গলায় ঝোলানো পদকটা ছাড়া ওর আর এখন কিছুই নেই।
ফ্রান্সিস আবারও কফির দোকানটার ভিতরে তাকিয়ে নিজেকে সেখানে কল্পনা করতে লাগলো। মনে মনে দেখতে পেলো ওর সাথের ব্যবসায়ীদের সাথে বসে ও ভারত থেকে সদ্য সেরে আসা ব্যবসা আর সেটা থেকে পাওয়া বিশাল মুনাফার কথা আলোচনা করছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দিতে যা করা দরকার ও সেটা করতে প্রস্তুত। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যেতে প্রস্তুত, যে কোনো কষ্ট সইতে রাজি, যে কোনো ঝুঁকি নিতে পিছপা হবে না। সফল হওয়ার জন্যে এমনকি মানুষও খুন করতে পারবে। যদিও চিন্তাটা মাথায় আসতেই ওর কাপুনি ধরে গেলো। ফ্রান্সিস মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো যে ও ওর ভাগ্যকে জয় করবেই নয়তো চেষ্টা করে জান দিতে হলেও দেবে।
অপেক্ষা করবে বলেই ঠিক করলো ফ্রান্সিস। প্রতিবার যখন দোকানটার দরজা খুলছিলো তখন ভিতরের খাবারের সুগন্ধে ওর জিভে জল চলে আসছিলো। সকালটা পড়ে আসতেই দেখা গেলো লোকজন মাংসের পাই বা গরম পেস্ট্রি হাতে গন্তব্যে হেঁটে যাচ্ছে। ওর গলায় ঝুলানো ব্যাগটার ওজন ওর কাছে ক্রমশ আরো ভারি লাগতে লাগলো; জিনিসটা এতো বেশি দামি, অথচ এটা বিক্রির কথা ভাবতেও পারে না। ও একবার ভাবলো আস্তাবলে ফিরে গিয়ে দেখে যে লোকটা হাইপেরিয়নকে বেচতে পেরেছে কিনা, কিন্তু স্যার নিকোলাসের সাথে দেখা করার কোনো সুযোগ যদি হাতছাড়া হয়ে যায় সেজন্যে যেতেও পারছে না।
ফ্রান্সিস জানে না যে কিভাবে স্যার নিকোলাসকে চিনবে। মা বলেছে যে চিল্ডস ওর দাদা হাল এর বন্ধু ছিলেন, তার মানে ওনার বয়স নিশ্চয়ই এখন অনেক বেশি। ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাড়িটার ভিতরে লোকজুনের আসা যাওয়া দেখতে লাগলো। পরিপাটি পরচুলা পরা বৃদ্ধ লোকেরা যেমন আসছে, তেমনি বই আর কাগজপত্রের বোঝা নিয়ে যুবকদেরকেও দেখা গেলো ভিতরে যেতে। প্রতিবার যখনই দরজা খোলা হচ্ছিলো দারোয়ানটা ওর দিকে সন্দেহজনকভাবে তাকিয়ে থাকছিলো, কিন্তু ফ্রান্সিস একবারও রাস্তা পার হলো না। একবার ওর মনে হলো যে কেউ একজন দোতলার ব্যালকনির ছায়া থেকে ওর দিকে। খেয়াল রাখছে। কিন্তু ও ভালো করে দেখার আগেই লোকটা ভিতরে চলে গেলো।
অক্টোবরের দিনটা বয়ে চললো। ছায়াগুলো লম্বা হলো আরো; খালি হয়ে গেলো কফির দোকানটা। গির্জার ঘণ্টা বাজিয়ে সন্ধ্যার প্রার্থনার সংকেত দেওয়া শুরু হলো। ফ্রান্সিস ভেবে পেলো না এখন ও কোথায় যাবে বা কি খাবে। দুপুরে দেখা সব দিবাস্বপ্নের কথা ভুলে গিয়েছে ততোক্ষণে। এখন ওর মাথায় ঘুরছে শুধু খাওয়ার কথা। ও ভেলভেটের ব্যাগটা স্পর্শ করে নাড়াচাড়া করলো কিছুক্ষণ। আস্তাবলের কাছেই ও একটা মহাজনের দোকান দেখেছিলো; ওখানে বন্ধক রেখে নিশ্চয়ই ভালো টাকা পাওয়া যাবে। কয়েকদিনই তো, হাইপেরিয়নের টাকাটা পেলাই শোধ করে দেবে। কিন্তু চিন্তাটা মাথায় আসতেই নিজের অক্ষমতার কথা ভেবে লজ্জা হতে লাগলো ওর।
চিন্তায় ডুবে থাকায় ফ্রান্সিস খেয়াল করলো না যে চাপরাসটা ওর দিকে এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি আসতে টের পেলো। লোকটার হাতে একটা কাগজে মোড়ানো গরম কেক।
“সারাদিন এখানে দাঁড়িয়ে আছো দেখলাম। কিছু তো খাও নি।”
ফ্রান্সিস লোকটার হাত থেকে কেকটা প্রায় কেড়ে নিয়ে গপাগপ খেতে আরম্ভ করে দিলো। কেকটার মিষ্টি স্বাদ আর আলমন্ডের সুঘ্রাণ আস্বাদনের অবস্থায় নেই ও আর এখন।
ফ্রান্সিস খাওয়ায় এতোই ব্যস্ত ছিলো যে দারোয়ানের সাথে আরো দুজন লোক এসেছে সেটা ও খেয়াল করার ফুরসত পায়নি। আচমকা এক জোড়া শক্ত হাত ওর হাত জোড়া চেপে ধরলো, আর একটা হাত চেপে ধরলো ওর মুখ। আর দারোয়ানটা হাতের লাঠি চেপে ধরলো ওর গলায়। দম বন্ধ হয়ে এলো ফ্রান্সিসের। অর্ধেক খাওয়া কেকটা মাটিতে পড়ে গেলো, আর একটু পরেই বুটের তলায় চাপা পড়ে মিশে গেলো রাস্তায়।
ফ্রান্সিস নিজেকে ছোটানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু কিছুই করতে পারলো না। দারোয়ান আর তার লোকেরা ওকে চ্যাং দোলা করে রাস্তা পেরিয়ে দালানের ভিতরে নিয়ে গেলো। ও এমনকি একটা চিৎকারও দিতে পারলো না। রাস্তার কেউ যদি ঘটনাটা দেখেও থাকে, তারা ভালোই জানে যে এসব ক্ষেত্রে না দেখার ভান করাটাই মঙ্গল।