“তোমার আর আমাদের বাচ্চার পাশে থাকা উচিত আমার,” টম প্রতিবাদ করলো।
“আমরা এখানে নিরাপদ আছি,” সারাহ বললো। “কিন্তু তরবারিটা এখনো ঐ শয়তানটার দখলে-আর ও ওটা দিয়ে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো। তোমাকে, আমাকে–আর ওকেও।” ও বাচ্চাটাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। বাচ্চাটা সারাহের স্তনে নাক ঘষছে আর ছোট্ট ছোট্ট আঙুল দিয়ে ওর স্তনের বোটা খুঁজছে।
কারো দৌড়ে আসার শব্দ পাওয়া গেলো। টম ঘুরে গেলো। ও ভাবেনি যে ক্রিস্টোফার ফিরে আসবে আবার, কিন্তু দুর্গে এখনো অনেকেই আছে। এই লুটতরাজ আর ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে যে কেউই ওদের জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
মোহিতকে আসতে দেখে শান্ত হলো ও। পিছনে আরো চারজন লোক।
“আমরা দস্যুদেরকে পানি পর্যন্ত ধাওয়া করে এসেছি,” হাবিলদার। জানালো। “ফেরার পথে আরেকটাকে পেয়েছিলাম কিন্তু সে পালিয়ে গিয়েছে।” বলে ও ভ্রু কুঁচকানো। “ঐ লোকটাই আমাদের সাথে বেঈমানি করেছে সম্ভবত। ওর হাতে একটা দারুণ সোনালি তরবারি দেখলাম।”
“অনেক ধন্যবাদ,” টম লোকটার কাঁধ স্পর্শ করলো। “এখানে থাকুন। আর একটু খেয়াল রাখবেন আমার… “ আবারও বাচ্চাটার দিকে নজর যেতেই ওর কথা জড়িয়ে এলো। পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছে এখন সে। “পরিবারের যেনো কিছু না হয়।”
“সাথে কাউকে দেবো?”
টম মাথা নাড়লো। “আমি একাই করবো কাজটা।”
*
টম আবার দুর্গের উপর দিকে দৌড়ে গেলো। এবার আর অসতর্ক না, কান খাড়া করে রেখেছে কারো পদশব্দ শুনতে পায় কিনা সেই আশায়। তরবারি প্রস্তুত-কিন্তু ওর চিন্তার প্রায় পুরোটা জুড়েই আছে অন্য একটা জিনিস : বাচ্চাটা, এতো ছোট আর অসহায়, ঠিক একটা পালকের মতো পলকা।
আমি একজনের পিতা।
তুমি আগেও বাবা হয়েছিলে, একটা নিষ্ঠুর কণ্ঠ ভিতরে ডেকে উঠলো। একটু আগে দেখা দানবটা যে ওর ছেলে সেটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। ক্রিস্টোফার, অ্যাগনেস, সারাহ আর বাচ্চাটাকে কি করতে চেয়েছিলো সেটা মনে আসতেই আবার ওর ভিতরটা শক্ত হয়ে গেলো।
আমার বাবা আমাকে বাধ্য করেছিলেন। হাল কোর্টনী যখন টমের সাথে ক্যারোলিনের মাখামাখির ব্যাপারটা টের পান, আর তার ফলে গাই আর টমের মাঝে গড়ে ওঠা তিক্ততার কথা জানতে পারেন, উনি সাথে সাথে গাই আর কোর্টনীকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেন। ওদেরকে বোম্বে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে, ক্যারোলিনের বাবার সহকারী হিসেবে গাই-এর জন্যে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেন। তখন কেউই টের পায়নি যে ক্যারোলিনের পেটে বাচ্চা আছে। টম এমনকি বিদায়-ও জানাতে পারেনি ক্যারোলিনকে।
টম ব্যাপারটা জানতো না, কিন্তু ওর বাবা ইচ্ছাকৃতভাবে ওর কাছ থেকে ব্যাপারটা লুকিয়ে রেখেছিলেন। যখন ক্যারোলিনের বাবা বাচ্চাটার কথা জানিয়ে হালকে চিঠি লিখেছিলেন, সেই চিঠি উনি পড়ে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে জানালা দিয়ে উড়িয়ে দেন। বহু পরে উনি টমকে ব্যাপারটা জানান, ডোরিয়ান হারিয়ে যাওয়ার পরে যখন ওরা ইংল্যান্ডে ফিরছিলো তখন।
আমারই উচিত ছিলো ক্যারোলিনকে বিয়ে করা। কিন্তু যতোই ভাবতে লাগলো, ততোই মনে হলো কাজটা ঠিক হতো না। তাহলে সারাহের সাথে বিয়ে হতো না। আর তাহলে সম্ভবতি কখনোই ডোরিয়ানকে উদ্ধার করতে পারতো না। এখন সারাহের গর্ভে ওর ছেলেটাও হতো না।
ফ্রান্সিসকে দেখো, নিজেকে বললো টম। ব্ল্যাক বিলির ঔরসে জন্ম, জুয়াড়ি সৎ বাবার কাছে মানুষ হয়েছে, জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু তবুও শেষ পর্যন্ত সত্যিকার একজন কোর্টনী-ই হয়েছে, নিজের পরিবারের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। জন্ম পরিচয়েই একজন মানুষ মানুষ হয় না, মানুষ হয় সে নিজেকে যা তৈরি করে তাতে।
“মিস্টার কোর্টনী?”
টম উপরের তলায় পৌঁছে গিয়েছে। পরিচিত কণ্ঠটা শুনতে পেয়ে ঘুরে তাকালো ও, মেরিডিউ দাঁড়িয়ে আছে দরজা ধরে।
“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে তুমি বেঁচে আছো,” টম বললো। “কিন্তু কিভাবে?” .
“মাস্টার ফ্রান্সিস আমদেরকে উপরে ফটক খুলতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখি, আপনিই আমাদের হয়ে কাজটা করে দিয়েছেন। আপনাকে খুঁজলাম এতোক্ষণ, না পেয়ে তাই আবার মাস্টার ফ্রান্সিসের কাছে যাচ্ছিলাম।”
“যাও।” মোহিত, সারাহ আর বাকিদের সাথে আছে। কিন্তু আরও কিছু লোক ওদের সুরক্ষায় থাকলে আরো ভালো হয়। তারপরই আর একটা চিন্তা মাথায় এলো। “এদিক দিয়ে সোনার পাত বসানো তরবারি হাতে কাউকে আসতে দেখেছো নাকি?”
মেরিডিউ মাথা নাড়লো। টম দুর্গের উত্তর-পূর্ব মিনারের উঠে যাওয়া আঁকাবাঁকা সিঁড়িটার দিকে তাকালো। “ও নিশ্চয়ই তাহলে উপরে গিয়েছে।”
সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো টম। খুব প্যাচানো সিঁড়ি। দেয়াল জুড়ে ছোট ছোট জানালা। ওগুলো দিয়ে নিচের চত্বরের দুই এক ঝলক চোখে পড়ছে। সূর্য উঠছে। লড়াই শেষ। শাহুজির লোকেরা ফটক খুলে সব দখলে নিয়ে নিয়েছে। রাজাকে দেখা গেলো বিশাল একটা হাতীর পিঠে চড়ে চিৎকার করে লোকজনকে আদেশ দিচ্ছেন। বন্দীদেরকে জড়ো করা হচ্ছে এক জায়গায়। যুদ্ধের কান ফাটানো তর্জন গর্জনের পর এখন এই সূর্য ওঠার আগ মুহূর্তের নীলচে আলোয় সবকিছু অপার্থিব নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে।