“কে তুমি?” জিজ্ঞেস করলো টম। ওর গলা শুকিয়ে গিয়েছে; কথাটা ফিসফিসানির মতো শোনালো।
ক্রিস্টোফার ওর চোখের দিকে তাকালো। দুজনের চোখই হুবহু এক। যেনো আয়নার দিকে তাকিয়েছে ও।
“আমি আপনার ছেলে।”
বলে উরুমি চালালো ক্রিস্টোফার।
কিন্তু কিছু একটা টেনে ধরলো ওকে পিছন থেকে। উরুমি নড়লো না। ফ্রান্সিস হেঁচড়ে হেঁচড়ে এগিয়ে এসে ওটার মাথা চেপে ধরেছে। সমস্ত শক্তি দিয়ে ধরে রেখেছে ফলাটা। চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে ফ্রান্সিসের। যেখানে ধরেছে। সেখানে আঙুল কেটে রক্ত পড়ছে, কিন্তু কিছুতেই ছাড়লো না ফলাটা।
প্রচণ্ড রাগে চিৎকার করে উঠে ক্রিস্টোফার উরুমিটা ছেড়ে দিয়ে নেপচুন তরবারিটা তুলে নিলো। এটাই ঠিক আছে। কোর্টনীদের তরবারি দিয়েই ও টমকে শেষ করবে। আর তরবারিটার উপর ওর উত্তরাধিকারটাও সুনিশ্চিত হবে।
কিন্তু ফ্রান্সিস যখন ক্রিস্টোফারকে আটকে রেখেছিলো তখন অ্যাগনেস নড়ে উঠলো। লাফ দিয়ে উঠে যেখানে টমের তরবারিটা পড়েছিলো সেখানে গিয়ে তরবারিটা তুলে নিয়ে টমের দিকে ছুঁড়ে দিলো। ক্রিস্টোফার ওকে নড়তে খেয়াল করলো। সাথে সাথে ও নেপচুন তরবারিটা চালালো কিন্তু অ্যাগনেস গড়িয়ে গুহার অন্যদিকে সরে গেলো। ক্রিস্টোফার আবার আক্রমণ করতে পারার আগেই টম ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর দিকে। রেগে মেগে সমস্ত শক্তি দিয়ে তরবারি চালালো টম, একদম শেষ মুহূর্তে কোনোমতে সরে গেলো ক্রিস্টোফার।
ক্রিস্টোফার ভাবলো ও যদি সারাহের কাছে পৌঁছে ওর গলায় তরবারি ধরতে পারে তাহলে টম আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। কিন্তু ফ্রান্সিস বিপদটা আঁচ করতে পারলো। ও মেঝে থেকে যতোটা পারলো সোজা হয়ে ক্রিস্টোফার আর সারাহের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
ক্রিস্টোফার চাইলে এক কোপে ফ্রান্সিসের ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে দিতে পারতো, কিন্তু সেটা করতে গেলে ওর পিঠ টমের দিকে ফিরে যেতো, টম আবার ওর দিকে আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে। টমের আক্রমণ নিজের তরবারি দিয়ে ঠেকালো ক্রিস্টোফার, ঝন ঝন শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে পড়লো সাড়া গুহা জুড়ে।
ওদের সবার বিরুদ্ধে ক্রিস্টোফার একা। ও খুব দ্রুত প্রতি আক্রমণ শুরু করলো। বহুল চর্চিত কয়েকটা আঘাত দিয়ে কোণঠাসা করে ফেললো টমকে। ক্রিস্টোফার এখনো প্রতিশোধের নেশায় পাগল হয়ে আছে, কিন্তু এখন অনেকগুলো বিপদ সামনে। দুর্গের পতন হয়েছে-কিছুক্ষণ পরেই লোকজন চলে আসবে এদিকে। ওকে পালাতে হবে দ্রুত।
টমকে ঠেলতে ঠেলতে সারাহের কাছে নিয়ে আসলো ও। এখন ক্রিস্টোফার আর দরজার মাঝে আর কিছুই নেই। ও আবার টমকে আক্রমণ করলো। একদম বই থেকে রপ্ত করা নিখুঁত সব আক্রমণ। আর ওর ধারণা মতোই টমও সহজেই ওগুলো আটকে দিলো। কিন্তু যেই টম উল্টো জবাব দিতে যাবে, তখনই ক্রিস্টোফার আচমকা পিছনে দিকে সরে গিয়ে, টম কিছু করার আগেই উল্টোদিকে ঘুরে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। একটু পরেই সিঁড়িতে হারিয়ে গেলো ওর পদশব্দ।
সারাহ কেঁদে উঠলো, ওর গোঙ্গানিটা এখন একটা তীক্ষ্ণ চিৎকারে রূপ নিয়েছে। টম দৌড়ে গেলো ওর কাছে।
রক্ত আর তরল উগরে দিয়ে বাচ্চাটা অ্যাগনেসের পেতে রাখা হাতে এসে পড়লো।
“ছেলে হয়েছে আপনার।”
বাচ্চাটার চেহারাটা একজন বৃদ্ধের মতো কুঁচকে আছে, চোখ বন্ধ, নাড়ি তখনও মায়ের সাথে সংযুক্ত। গায়ের ত্বক অস্বাভাবিক নীল।
“ও কি…বেঁচে আছে?” টমের ভিতর এতো জোরে আবেগের ঝড় বইতে লাগলো যে অসুস্থ্য লেগে উঠলো ওর। এক মিনিট আগে, ও এমন এক শয়তানের বিরুদ্ধে লড়ছিলো, যে দানব কিনা ওর নিজেরই সৃষ্টি; এখন আবার সারাহের সাথে দেখা হলো, সেই সাথে বাবাও হলো। ওর মাথার ভিতর এতো বেশি চিন্তা ঘুরতে লাগলো মনে হলো যেনো মাথাটা ছিঁড়ে বের হয়ে যাবে সব।
অ্যাগনেস বাচ্চাটার পিঠে একটা চাপড় দিতেই ওটা কাশি দিয় উঠলো। শ্লেম্মা বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে। বাচ্চাটা অর্ধেক চোখ খুলে টমের দিকে কেমন ঢুলুঢুলু বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
“ওকে নিন, অ্যাগনেস আগ্রহ ভরে বললো। “আপনার ছেলে।”
অ্যাগনেস বাচ্চাটাকে টমের বাহুতে বসিয়ে দিলো। যদিও টমের সাহস হচ্ছিলো না ওকে ধরার। বাচ্চাটা এতো ছোট, ওজনটাও অনুভব করতে পারলো না ও। কিন্তু তবুও যেই মুহূর্তে ও নিজের ছেলেকে স্পর্শ করলো তখনি এমন একটা ভালোবাসা আর দায়িত্বশীলতা ওর ভিতরে উথলে উঠলো, যা এর আগে কখনোই অনুভব করেনি। ওর চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে এলো। এততক্ষণ ভরে যে আবেগের ঝড় বইছিলো, স্তিমিত হয়ে গেলো সেটা। ছেলের নিষ্পাপ চোখ দুটোয় যে নির্মল শান্তি তা শান্ত করে দিলো সব অস্থিরতাকে।
কিন্তু ওর কাজ এখনো শেষ হয়নি। ও দ্রুত বাচ্চাটাকে সারাহের বাড়িয়ে রাখা হাতে ধরিয়ে দিলো।
“যাও,” সামান্য পরেই সারাহ বললো। সব ব্যথা এক নিমিষে চলে গিয়েছে ওর। এখন উঠে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে। ওর মাথার চুল পড়ে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে, চেহারা ভর্তি ঘাম, পা ভরা রক্ত। গায়ে একদম কিছুই নেই। বাচ্চার নাড়িটা তখনও ওর দুই পায়ের। ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে। কিন্তু তবুও ও এমন একটা আভায় জ্বলজ্বল করছে : যা টম আগে কখনোই দেখেনি। যেনো ভিতর থেকেই একটা নিশ্চয়তা ওকে জানিয়ে দিচ্ছে যে ওর একটা অংশ নতুন করে জন্ম গ্রহণ করেছে। টমের মনে হলো সারাহকে এর আগে কখনো এতোটা সুন্দর লাগেনি।