“এখন!” চেঁচিয়ে উঠলো ক্রিস্টোফার। সাথে সাথে তরবারিটাও নামিয়ে আনলো। চত্বরের কামানগুলো একসাথে গর্জে উঠলো। একগাদা মাস্কেটের গুলি আর অসংখ্য ভাঙা ধাতুর টুকরো ছুটে গেলো সামনে। যারা এগিয়ে এসেছিলো তারা সাথে সাথে মাংসের দলায় পরিণত হলো।
দেয়ালের ভাঙা জায়গাটা খালি হয়ে গেলো মুহূর্তেই। দস্যুরা উল্লাস করে উঠলো। বিজয় বুঝতে পেরে ওরা সবাই ভাঙা জায়গাটায় দৌড়ে গেলো ওদের সদ্য বিজিত প্রতিদ্বন্দীদের উপহাস করতে।
“থামো,” চেঁচিয়ে উঠলো ক্রিস্টোফার। কিন্তু কেউ ওর কথা শুনতে পেলো না বা শুনলেও পাত্তা দিলো না। কয়েকজন মাস্কেট ফেলে দিয়ে তরবারি তুলে নিলো যাতে কাছ থেকে মারতে পারে।
ক্রিস্টোফারের মতো ওরাও ভেবেছিলো যে কামানের গোলাটা মারাঠাদের যুদ্ধ করার ইচ্ছা মিটিয়ে দেবে। তাছাড়া ধোয়া কেটে যাওয়ার পরে দেখা গেলো ঢালের নিচের লোকগুলোর বিহ্বল দশা তখনও কাটেনি। ওদের মাঝে একজন উঠে দাঁড়ালো, তারপর নিজে ভাঙা জায়গাটার দিকে দৌড় দিলো আর চিৎকার করে বাকিদেরকেও আক্রমণ করতে আদেশ দিতে লাগলো। বাকিরা সাথে সাথে উঠে এলো ওর পাশে। কারো হাতে কুড়াল, কারো হাতে বল্লম, একজনের হাতে একটা বিশাল জৈত্রি, মধ্যযুগীয় নাইটদের মতো সেটাকে নাড়ছে।
দস্যুরা কোনো প্রতিরোধ আশা করেনি। অতিরিক্ত উৎসাহে ওরা একেবারে সোজা শত্রুদের মুখে পড়ে গেলো। এখন সেই সুযোগ গ্রহণ করলো মারাঠারা। ওরা দস্যুদের পা কেটে দিলো, ফলে ওরা ভাঙা পাথর বেয়ে নিচে পিছলে পড়তে লাগলো। যাদের হাতে অস্ত্র নেই তারা পাথর তুলে নিয়ে শত্রুদের মাথার ঘিলু বের করে দিতে লাগলো। দস্যুরা বিভ্রান্ত হয়ে গেলো যে কি করবে।
দ্বিতীয়বারের মতো মারাঠারা দেয়ালের ভাঙা জায়গাটায় উঠে এলো। আবারও ক্রিস্টোফার অপেক্ষা করতে লাগলো কামানের গোলার আঘাতে ওদের উড়ে যাওয়ার, কিন্তু এবার দেখা গেলো কামানের কাছে কেউ নেই। গোলন্দাজেরাও মারামারি করতে ছুটে যাওয়ায় কেউ কামানে গোলা ভরেনি।
ক্রিস্টোফার গালাগালির তুবড়ি ছোটালো। ভাঙা দেয়ালের উপর একজনকে দেখা গেলো বিজয়োল্লাসে নিজের ততবারি তুলে ধরেছে। অবয়বটা টম কোর্টনী বাদে আর কারো না। ক্রিস্টোফার একটা বন্দুক তুলে নিয়ে টম কোর্টনীর বুক বরাবর তাক করলো। কিন্তু ধোয়ার কারণে টম ওর আড়ালে চলে গেলো। ধোয়া কাটতেই দেখলো টম আর ওখানে নেই।
প্রচণ্ড রাগে অস্ত্রটা আছড়ে ফেললো ক্রিস্টোফার। ওর সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে। ও জানে দস্যুরা কিভাবে লড়াই করে। যখন সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে, তখন ওরা অজেয়-কিন্তু একবার যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেলেই ওদের নিয়ম শৃঙ্খলার আর কোন বালাই থাকে না। শেষ মুহূর্তের প্রতিরোধ বলে এদের মাঝে কিছু নেই। এরমধ্যেই ও দেখতে পেলো দস্যুরা চত্বর জুড়ে পালানো আরম্ভ করেছে। পিছনে ধাওয়া করছে মারাঠারা। দেয়ালের ভাঙা অংশ দিয়ে এখন বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো এসে ঢুকছে ওরা। দুর্গের পতন ঘটে গিয়েছে।
পরাজয় আর রাগ দুটো অনুভুতিই একসাথে গ্রাস করলো ক্রিস্টোফারকে। টম কোর্টনী-ই এর জন্যে দায়ী। এখানে, বা ব্রিঞ্জোয়ানে সবখানেই। ওর জীবনের প্রতিটা বাকে-সেই মায়ের পেটে আসার পর থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যেখানে যা কিছু ক্রিস্টোফার চেয়েছে তার সবকিছুই এই লোকটা ছিনিয়ে নিয়েছে। ওর জন্মদাতা পিতা টম কোর্টনী-ই হচ্ছে ওর জন্ম শত্রু।
কিন্তু পরাজিত হলেও এখনো ও চাইলে টমের বিজয়কে ভস্ম করে দিতে পারে। ও দেয়াল ধরে দৌড়ে গিয়ে দুর্গে ঢোকার দরজাটা দড়াম করে খুলে ভিতরে ঢুকে গেলো।
শত্রুরা ঢোকার আগেই লুটপাট শুরু হয়ে গিয়েছে। হেরে যাওয়ায় দস্যুরা এখন একজন আর একজনের সাথে লেগেছে। নিজের আখের গোছানোর চেষ্টা করছে সবাই। পালাতে পারবে এই আশায়, ভাড়ার ঘরে ঢুকে বহন করতে পারবে এমন যা যা পাচ্ছে নিয়ে নিচ্ছে ওরা।
ক্রিস্টোফার ওসবের ধার ধারলো না। ও এই হৈ হট্টগোল পেরিয়ে একটা চরম নিষ্ঠুর উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে চললো। দুই একজন দস্যু ওর হাতের তরবারিটা খেয়াল করে এগিয়ে এসে ওটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে চাইলো, কিন্তু ওর চেহারার দিকে একবার তাকিয়েই বুঝে গেলো সে চেষ্টা না করলেই ভালো করবে। বাকিরা লুটপাটে এতো ব্যস্ত ছিলো যে ওকে খেয়াল করলো না।
দস্যুরা দুর্গের ভিতরে ঢুকে যেতেই শোরগোল কমে এলো অনেকটা। ক্রিস্টোফার ওর গতি বাড়িয়ে দিলো, তারপর থেমে গেলো আচমকা। ছুটন্ত পদশব্দ শুনতে পাচ্ছে। উপর থেকে না, নিচ থেকে আসছে। ও দেয়ালের পাশের একটা কুলুঙ্গিতে ঢুকে অন্ধকারে লুকিয়ে পড়লো।
প্রায় ডজনখানেক লোক দৌড়ে উঠে গেলো। ওদের পোশাক দেখে বুঝলো যে এরা মারাঠা, তবে সবার সামনের লোকটা একজন ইংরেজ নাবিক। এক মুহূর্ত ক্রিস্টোফার ভাবলো ওটা টম নাকি। হয়তো ও আসলে দেয়ালের দিকে আসেইনি। ক্রিস্টোফারের হাত তরবারির হাতলে চেপে বসলো। ও শুধু হাতটা বাড়ালেই ইংরেজটার কল্লা পড়ে যেতো।
“তাড়াতাড়ি,” লোকটা ডাকলো। কণ্ঠ শুনে ক্রিস্টোফার স্বস্তি পেলো। টম না ওটা। ও ওদেরকে যেতে দিলো। একটু পরেই ওদের পদশব্দ মিলিয়ে গেলো উপরে।
ক্রিস্টোফার আবার নামতে শুরু করলো। একটু পরে ছোট একটা কক্ষে চলে এলো যেখানে রাস্তা দুই দিকে গিয়েছে। কিন্তু এবার সাথে সাথে আরো অনেকগুলো পদশব্দ পাওয়া গেলো। আর এখানে লুকানোরও কোনো জায়গা নেই। ও অস্ত্র তুলে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ালো।