প্রথম অগ্নিকুটা জ্বলে ওঠা মাত্র ও টের পেলো ওর পরিকল্পনা একদম ঠিকঠাক খেটে যাচ্ছে। দেয়ালের এখান থেকে ও দেখতে পেলো যে শত্রুদের নৌকাগুলো একেবার বন্দরের মাঝে আটকা পড়ে গিয়েছে। আংরিয়ার বাহিনি ঘিরে ফেলছে ওদেরকে। এখান থেকে আর পালানোর উপায় নেই।
কিন্তু ওরা এখনো জানে না যে কেন এভাবে ধরা খেলো। ও আশ্চর্য হয়ে দেখতে পেলো নৌকা একটা গ্রাবের গায়ে এসে ঠেকলো, তারপর আরোহীরা জাহাজটায় চড়ে বসে কোনোভাবে জাহাজটা দখল করে নিয়ে ছড়িয়ে থাকা অন্য জাহাজগুলোর ফাঁক দিয়ে চালানো শুরু করে দিলো। দস্যু গোলন্দাজদের এতো চেষ্টা সত্ত্বেও ওটা ডুবলো না বা একটা মাস্তুলও ভাঙলো না। বরং ওটাই যাওয়ার পথে অন্য কয়েকটা জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিয়ে, সোজা পালানো শুরু করলো।
তবে পালাতে পারবে না। সবগুলো নৌকা উপসাগরে ঢোকার পরেই ক্রিস্টোফারের লোকেরা বেড়াটা আবার লাগিয়ে দিয়েছে। জাহাজটা যদি কোনোমতে এখান থেকে পালিয়ে যেতেও পারে, বেড়ার কাছে গিয়ে প্রজাপতি যেভাব জালে আটকায় সেভাবেই আটকে পড়বে।
জাহাজটার ধ্বংস দেখার আশায় তাকিয়ে থাকতেই আর একটা নতুন শব্দ কানে এলো ওর : চেঁচামেচি, আর্তচিৎকার আর অস্ত্রের ঝনঝনানি। সৈন্যদল ধেয়ে আসছে।
“হচ্ছেটা কি?”
অন্ধকার কুঁড়ে আংরিয়ার গলা হিসিয়ে উঠলো। ক্রিস্টোফার ওর উঠে আসার আওয়াজ পায়নি। ও ঘুরে গেলো, কিন্তু আংরিয়া একদম ওর পিছনেই চলে এসেছিলো। কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই ও ক্রিস্টোফারকে দুই হাতে ধরে আগের দিকে ফিরিয়ে দেয়ালের কিনার দিয়ে ঠেসে ধরলো। ওখানেই ঝুলে রইলো ক্রিস্টোফার। আংরিয়া ওর হাতটা ছেড়ে দিলেই সোজা নিচে গিয়ে পড়বে।
“এসব কি তোর কাজ?” আংরিয়া জানতে চাইলো। “আমার লোকদের দুই ভাগে ভাগ করে ফেলার জন্যে কোনো চালাকি? যাতে আমার শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে?”
“না, প্রভু,” মিনতি করলো ক্রিস্টোফার। দেয়ালের উপর ভারসাম্য রাখতে গিয়ে বারবার পিছলে যাচ্ছে পা। নিচে পড়লে কতোদূর যাবে সেদিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না ওর। “আমি জানিও না-”
“মারাঠারা আক্রমণ করছে। যখন আমাদের সমস্ত মনোযোগ বন্দরের দিকে, ওরা তখন দেয়ালের দিক থেকে আক্রমণ করছে।”
“আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে ওরা আক্রমণ করবে। আমাদের চরেরা ডাঙার দিকে দিয়ে আক্রমণের কোনো লক্ষণই দেখতে পায়নি ওদের মধ্যে।”
আংরিয়া ক্রিস্টোফারের চোখের দিকে তাকালো। যা-ই দেখে থাকুক তাতে ও ক্রিস্টোফারের কথাকেই সত্যি বলে ধরে নিলো। ওকে টেনে তুলে একটা কামানের গায়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বললো, “পূর্ব দেয়ালের দিকে যা। ফটক রক্ষার দায়িত্ব তোর। আর আমি বলে দিচ্ছি যে, কেউ যদি তোকে কাজে সামান্যতমও কোনো ত্রুটি করতে দেখে, তাহলে যেনো সাথে সাথে তোর কল্লা নামিয়ে দেয়।”
ক্রিস্টোফার দেয়াল ধরে দৌড়ে গিয়ে উত্তর-পূর্ব মিনারে যাওয়ার সিঁড়ি ধরে উঠে গেলো। নিচে যা দেখলো তাতে নিজের চোখকে বিশ্বাস হলো না ওর। পুরো শৈল অন্তরীপ একটা জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। ওদের মাঝখানে আবার তিনটা বিশাল হাতীও আছে। দুর্গের কামানের গোলায় এর মধ্যেই আক্রমণকারীদের অনেকেই আহত নিহত হয়েছে। কিন্তু তাতেও ওরা এক বিন্ধু দমেনি। কয়েকজনকে দেখে মনে হলো উলঙ্গ। ক্রিস্টোফার ভাবলো মারাঠারা বোধহয় বন্দীদের সামনে দিয়েছে যাতে কামানের গোলার আঘাত ওদের উপর দিয়ে যায়।
ওরা দেয়ালের ভাঙা অংশটা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করবে। বুঝতে পারলো। ক্রিস্টোফার।
দুর্গে যারা যারা ছিলো তারা সবাই দুর্গের পূর্বে ছুটছে। ক্রিস্টোফার একজন গোলন্দাজ ক্যাপ্টেনকে দেখতে পেলো। “দেয়ালের ভাঙা জায়গা বরাবর দুটো কামান বসিয়ে দাও। আর ওগুলোর ভেতর মাস্কেটের গুলি আর টুকরো টাকরা যা যা পাও ভরে রাখো। যদি ওরা দেয়ালের উপর উঠেই পড়ে, তাহলে একেবারে গাছের ডালের পাখি মারার মতো ওদেরকে উড়িয়ে দিতে পারবে।”
ক্রিস্টোফার জানে যে টম কোর্টনী-ই আছে এর পেছনে। ও অন্ধকারে ওকে খুঁজতে থাকলো। মাস্কেট আর কামানের গোলা ছোঁড়ার সময় যে আগুন বের হচ্ছে তার আলোয় চেহারাটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। উনি কি আক্রমণের নেতৃত্ব দেবেন? নাকি চালাকি করে অন্য লোকদের দিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করবেন?
আক্রমণকারীরা এখন এতো কাছে চলে এসেছে যে দুর্গের কামানগুলো দিয়ে আর ওদের গায়ে লাগানো সম্ভব না। ক্রিস্টোফার গোলন্দাজদেরকে কামান ফেলে দেয়ালের বন্দুকবাজদের সাথে যোগ দিতে আদেশ দিলো। প্রকাণ্ড একটা গর্জন ভেসে এলো দেয়ালের ওদিক থেকে। কোনো মানুষ এই আঘাত সহ্য করতে পারবে বলে ও বিশ্বাস করে না। কিন্তু তবুও দেখা গেলো ওরা আসছেই। ধোয়ার ভিতর দিয়ে ক্রিস্টোফার দেখলো ওদের ধুলোয় ভরা দেহগুলো হামাগুড়ি দিয়ে ধ্বংসস্তূপের ঢাল বেয়ে উঠে আসছে। ভাঙা পাথরের টুকরোগুলোর নিচে লুকাচ্ছে, আবার উঠে আসছে। বেশ কয়েকজন দস্যু মারা পড়লো তাতে, অন্যেরা গিয়ে জায়গা নিলো তাদের।
ওদেরকে থামাতে হবে। “গুলি থামিয়ে দাও,” ক্রিস্টোফার বললো। “ওদেরকে ভাবতে দাও যে ওরা বিজয়ী হয়েছে।”
আদেশটা দেয়াল জুড়ে পৌঁছে গেলো। মাস্কেটের গুলি বর্ষণ থেমে গেলো। ক্রিস্টোফার হাতের নেপচুন তরবারিটা তুলে ধরলো যাতে নিচে চত্বরের দস্যুরা ওটা দেখতে পায়। মারাঠারা এটাকে সুযোগ মনে করে আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসে শেষ কয়েক গজ পেরিয়ে দেয়ালের উপর উঠে এলো।