সিঁড়ির একদম গোড়ায় একটা লোহার দরজা দেখতে পেয়ে থেমে গেলো ফ্রান্সিস। দরজায় কোনো প্রহরী নেই। আর চাবিও তালার ভিতর ঢোকানো-তবে ভিতর থেকে। ও ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো দরজাটা।
নিয়মিত বিরতিতে চিৎকার চলছেই। যেনো কেউ একটা গরম ছুরি কারো পেটে ঢুকিয়ে একটু পরপর মোচড় দিচ্ছে।
এক হাতে তরবারি আর এক হাতে পিস্তল নিয়ে ফ্রান্সিস যথাসম্ভব শব্দ না করে এগিয়ে গেলো সামনে। শব্দ অনুসরণ করে কয়েকটা পাথরের ঘর পার হয়ে এলো ও। একটু পরেই একটা বাঁকে এসে উপস্থিত হলো। শব্দের তীব্রতায় বোঝা গেলো এর পরের গুহাটা থেকেই আসছে চিৎকার। ও দেয়ালের গায়ে নিজেকে চেপে ধরলো, তারপর সোজা হয়ে আড়াল থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এলো, হাতে উদ্যত পিস্তল।
কিন্তু যা দেখলো তাতে হতভম্ব হয়ে গেলো পুরোপুরি।
সারাহ চিত হয়ে শুয়ে আছে, পা দুদিকে ছড়ানো, পুরো শরীরটা ফ্রান্সিসের দিকে ফেরানো। গায়ে একটা সুতা পর্যন্ত নেই। অ্যাগনেস ওর পাশে হাঁটু মুড়ে বসে সারাহের মাথাটা নিজের মাথায় নিয়ে আদর করছে আর ফিসফিস করে সান্ত্বনা দিচ্ছে। সারাহের চোখ খোলা কিন্তু ফ্রান্সিসের আগমন টের পেলো না ও। অ্যাগনেস সারাহের উপর পড়া ছায়াটা দেখতে পেয়ে চোখ তুলে তাকালো।
“ফ্রান্সিস?” চমৎকৃত হলো অ্যাগনেস।
ফ্রান্সিস ওদের দিকে দৌড়ে গিয়ে অ্যাগনেসের পাশে বসে পড়লো। আবারও তীব্র যন্ত্রণার একটা ঢেউ ছড়িয়ে পড়লো সারাহের শরীর জুড়ে। আগেরটার চাইতে বেশি থাকলো এবার। অ্যাগনেস সারাহের কপালের ঘাম মুছিয়ে দিলো।
“ওনার কি-?” ফ্রান্সিস আর এক দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো। সারাহের নগ্ন শরীরের দিকে তাকাতে পারছে না। “কি হয়েছে? ওরা কি খুব অত্যাচার করেছে?”
এই দরম দুর্দশার মাঝেও অ্যাগনেস হেসে দিলো। “আরে বোকা, ওর বাচ্চা হচ্ছে। আর বেশি দেরি নেই।”
“বাচ্চা?” ফ্রান্সিস হাঁ হয়ে গেলো। “কিন্তু কিভাবে?”
“ভয় পেয়ো না। দস্যুরা ওর কোনো ক্ষতি করেনি। এটা টমেরই বাচ্চা, তোমার চাচাতো ভাই। মানে, যদি শেষ পর্যন্ত আজকের রাতটা পার করতে পারে।”
সারাহের চিৎকারের মাত্রা কমে ফোপানিতে পরিবর্তিত হলো। অ্যাগনেস ওর কাধ ধরে আস্তে আস্তে তুলে বসালো।
“ওকে ঘোরাতে সাহায্য করো দেখি,” অ্যাগনেস বললো। “বাচ্চা বের হতে সহজ হবে তাহলে।”
ফ্রান্সিস হাই উইল্ডে ঘোড়া আর ভেড়ার বাচ্চা প্রসব দেখেছে। তাই বাচ্চা জন্মদান সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ না ও। কিন্তু এরকম একটা লড়াইয়ের মাঝে যে ওকে দাই-এর ভূমিকা পালন করতে হতে পারে তা ওর সুদূরতম কল্পনাতেও ছিলো না। ও হাতের অস্ত্রগুলো নামিয়ে রাখলো। তারপর অ্যাগনেস আর ও ধরাধরি করে সারাহকে চার হাত পায়ে বসিয়ে দিলো। প্রচণ্ড জোরে হাফাচ্ছে সারাহ।
উপরে আবার কামানের শব্দ পাওয়া গেলো। এতোক্ষণে ফ্রান্সিসের এই হুট করে আগমনের ব্যাপারটা খেয়াল হলো অ্যাগনেসের। “গোলা কি তোমরা মারছো নাকি? এখানে এলে কিভাবে? দুর্গ দখল করে ফেলেছো? টম কোথায়?”
“সত্যিটা হচ্ছে আমি জানি না যে কি হচ্ছে,” ফ্রান্সিস স্বীকার করলো। “আমি আংরিয়ার বন্দরের জাহাজগুলো ধ্বংস করতে এসেছিলাম। কিন্তু ধরা পড়ে যাই। তারপর পালাতে গিয়ে পানির ধারের যে দরজাটা আছে ওটা দিয়ে উঠে এসেছি। আমার মনে হয় টম চাচা উপরে ফটকের দিক থেকে আক্রমণ করেছেন যাতে আমাদের দিক থেকে নজর সরে যায়। কিন্তু এখন ওখানে কি অবস্থা সেটা জানিনা।”
সারাহ গুঙিয়ে উঠলো। এবার অন্যরকম একটা শব্দ। নিচু কিন্তু আগের গুলোর চাইতে বেশি স্পষ্ট, যেনো ও বিশাল একটা ওজন তোলার চেষ্টা করছে। অ্যাগনেস ওকে জড়িয়ে ধরলো।
“বাচ্চা হয়ে যাবে এখনি।”
*
রাতটা প্রচণ্ড অস্থিরতায় কাটলো ক্রিস্টোফারের। ফাঁদ পাতা শেষ, শুধু শিকার আটকা পড়ার অপেক্ষা। কিন্তু সব ঠিকমতো হবে কিনা সেই দুশ্চিন্তা ওকে কুরে কুরে খেতে লাগলো। ও আংরিয়াকে বন্দরে আক্রমণের খবরটা দিয়েছে। দস্যুদেরকে এটা বিশ্বাস করিয়ে ছেড়েছে যে শত্রুদেরকে ধোকা দেওয়াই ওর উদ্দেশ্য ছিলো। অবশ্য ও যে হীরা ভর্তি থলেটা পেয়েছে সেটার কথা চেপে গেলো বেমালুম। সেটা এখন ওর ঘরে একটা বেল্টের ভিতরে নিরাপদে সেলাই করে রেখে দেওয়া হয়েছে। টম কোর্টনী সম্পর্কেও কিছু বললো না। প্রতিশোধটা ও ব্যক্তিগত ভাবেই নেবে।
ক্রিস্টোফার নিজে বন্দরের আক্রমণটায় নেতৃত্ব দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু আংরিয়া নিষেধ করলো। কারণ ধূর্ত দস্যুর মাথায় তখন এটা ঘুরছে যে ক্রিস্টোফার মারাঠাদের সাথে যে বেঈমানি করার কথা বলছে সেটা কি আসলে ওদের সাথে করবে কিনা শেষ পর্যন্ত। ও ক্রিস্টোফারকে দুর্গ ছেড়ে নড়তে নিষেধ করে দিলো। ক্রিস্টোফার উপসাগরটার দিকের দেয়ালে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে আর দুশ্চিন্তা করছে। যদি টম ওকে চিনে ফেলে? যদি ও ক্রিস্টোফারের বেঈমানির কথা বুঝে ফেলে? যদি ওরা না আসে? ও দেয়ালের উঁচু অংশটায় হেলান দিয়ে রাতের আধারে তাকিয়ে রইলো। হাতে নেপচুন তরবারিটা নাড়ছে। উরুমিটা ওর কোমরে শক্ত করে আটা। লিডিয়ার কথা ভাবলো ও, ওর ঘরে অপেক্ষা করছে। ওর কাছে গেলে অবশ্য এসব কিছুক্ষণের জন্যে ভুলে থাকা যাবে। কিন্তু সেসব পরে করলেও হবে। বিজয়ীর বেশে যখন ফিরবে তখন ওর সঙ্গ আরো মধুর মনে হবে।