বিশাল কামানটার পিছনে লুকিয়ে ও সামনের ফাঁকা দিয়ে উঁকি দিলো। জেটির লোকজন কামানটা সুবিধামতো বসিয়ে ফেলেছে। এখন দ্রুত গোলা ভরার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ যেনো একটা রাউন্ড ধরে খেলা ডুয়েল। দুই পক্ষই চেষ্টা করছে অন্যদলের আগেই গুলি করতে।
গ্রাবটা থেকেই গোলা ছোঁড়া হলো প্রথমে। কামানগুলো গোলা ছুঁড়ে আঁকি দিয়ে পিছিয়ে গেলো। কিন্তু সেই গর্জন ছাড়িয়ে আরো প্রচণ্ড একটা শব্দ ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে। জাহাজটা সজোরে গিয়ে জেটিতে আছড়ে পড়েছে। পানির বেশি গভীরে ডুবে ছিলো না জাহাজটা, ফলে একদম ডাঙার কাছে চলে যেতে পেরেছে। ওটার সামনের দিকটা একদম ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পাথরুের উপরে উঠে গেলো। ডেক-এর লোকজন সব আছড়ে পড়লো এদিক সেদিক। জাহাজের কামানগুলোও ছিটকে গিয়ে কাত হওয়া ডেক ধরে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। একটুর জন্যে ফ্রান্সিসের পা থেতলে গেলো না।
“ওঠো সবাই!” চিৎকার করে উঠলো ও। “আক্রমণ করো ওদেরকে!”
গ্রাবের সামনের দিকটা ভোতা করে নকশা করা হয়েছে যাতে অন্য নৌকা এতে ওঠানো যায়। এখন জায়গাটা সুন্দর একটা পাটাতনের মতো কাজ করলো। পাথরের উপর দিয়ে সোজা জেটি পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে সেটা। ফ্রান্সিসের নেতৃত্বে মারাঠারা ওটা ধরে দৌড়ে গেলো। তারপর রণহুংকার ছাড়তে ছাড়তে ওটার শেষ মাথা থেকে লাফিয়ে নেমে, ঝাঁপিয়ে পড়লো দস্যুদের উপর।
কামানের সর্বশেষ গোলাটায় ভালোই কাজ হয়েছে। দস্যুদের কামানটা উল্টে পড়ে গিয়েছে। পাশে যারা ছিলো, তারা নিজেদের রক্তে গোসল হয়ে পড়ে আছে পাশে। বাকিদেরকে পেড়ে ফেলতে কোনো কষ্টই হলো না ফ্রান্সিসদের। ফ্রান্সিস একজনের বুকে তরবারি ঢুকিয়ে দিলো। তারপর চারপাশে তাকিয়ে দেখে আর কোনো শত্রু জীবিত নেই।
জেটি এখন ওদের দখলে।
“এখন?” মেরিডিউ জানতে চাইলো। হাতের কুড়াল থেকে রক্ত মুছছে। ও পাথরে গাথা আঙটাগুলো দেখালো। ওখানেই গাছের গুঁড়িগুলো বাধা। “বেড়াটা কেটে দেবো?”
“খুব বেশি লাভ হবে না আর। পালানোর জন্যে আর কোনো জাহাজ তো নেই।”
একটা মাস্কেটের গুলি এসে লাগলো দেয়ালে। ওদেরকে ধাওয়া করে আসতে থাকা নৌকার বহরটা কাছিয়ে এসেছে। সামনের গালিভাতটাতো একেবারে ওদের ভাঙা জাহাজটার পাশেই চলে এসেছে। ওটার লোকজন লাফিয়ে জাহাজের ডেক-এ নেমে যেতে লাগলো, জেটিতে পৌঁছানোর জন্য ওটাকে একটা সেতুর মতো ব্যবহার করছে।
জেটিতে লুকানোর আর কোনো জায়গা নেই। শুধু পাহাড়ের গায়ের ছোট দরজাটা ছাড়া।
“দুর্গে চলো সবাই,” চেঁচিয়ে উঠলো ফ্রান্সিস। আগে ও ওর সবগুলো লোককে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে, সবার শেষে ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। সাথে সাথে তিনটা গুলি এসে লাগলো কাঠের দরজাটায়।
দেয়ালের একটা খোপে একটা বাতি জ্বলছে। ওরা কয়জন আছে গুণে নিলো ফ্রান্সিস। কাটায় কাটায় বারোজন মারাঠা, সাথে ও নিজে আর মেরিডিউ। এর মাঝে অর্ধেক আহত। এক হাজার লোকের বাহিনির বিরুদ্ধে এই ক্ষুদ্র একটা দল!
বাইরে থেকে প্রচণ্ড ধাক্কায় দরজাটা কেঁপে উঠতে লাগলো।
“দরজাটা কিন্তু বেশিক্ষণ টিকবে না,” সাবধান করলো মেরিডিউ।
ফ্রান্সিস ওর পিস্তলে গুলি ভরে নিলো। “খোলা মাত্র ওদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হবে।”
“সম্ভবত অন্য কোনো রাস্তা আছে,” মেরিডিউ একটা কানে হাত দিয়ে শোন্তর চেষ্টা করতে করতে বললো। “উপরে বোমার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন?আমার মনে হয় মিস্টার টম আমাদের দিক থেকে দস্যুদের দৃষ্টি সরাতে ফটকের দিক থেকে আক্রমণ চালিয়েছেন। কিন্তু ঐ দরজা খুলতে ওনাদের খবর হয়ে যাবে। আমরা যদি উপরে গিয়ে দরজাটা খুলে দিতে পারি, তাহলে পুরো পরিস্থিতির মোড় ঘুরে যাবে।”
ফ্রান্সিস কাঁধের ওপর দিয়ে তাকালো। একটা খাঁড়া সিঁড়িপথ পাথরের ফাঁক দিয়ে দুর্গের উপরে উঠে গিয়েছে। ওখানে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত সবাই-ই এখন উপরে যুদ্ধে ব্যস্ত।
আবারও কেঁপে উঠলো দরজাটা। কাঠ ভেদ করে একটা কুড়ালের মাথা দেখা গেলো। সেটা খুলে নিয়ে আবার চালানো হলো। ফুটোটাও বড় হতে লাগলো তাতে।
“তাহলে আর সময় নষ্ট করার দরকার নেই।”
ফ্রান্সিস আর ওর লোকেরা দৌড়ে গেলো সেদিকে, হাতে পিস্তল। সামান্য দূর যাওয়ার পরেই দড়াম করে দরজাটা ভেঙে পড়ার আওয়াজ শুনতে পেলো। অনেকগুলো মানুষ চিৎকার করতে করতে একসাথে ঢুকে পড়লো ভেতরে। ফ্রান্সিস গতি বাড়িয়ে দিলো, এক যোগে তিনটা করে সিঁড়ি ভাঙছে। সিঁড়ির প্রতিটা কোনায় লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে গেলো, ওদিকে কেউ আছে কিনা সেই পরোয়া করছে না।
ওরা একটা জায়গায় এসে পড়লো যেখানে সিঁড়িটা দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে। ডান দিকে একটা নেমে গিয়েছে নিচে, আর একটা উঠে গিয়েছে উপরে।
ফ্রান্সিস উপরে দেখালো। “এদিকে। এটা দিয়েই-”।
একটা গা শিউরানো চিৎকার ভেসে এলো নিচের সিঁড়িটা দিয়ে। ফ্রান্সিস থেমে গেলো।
“অন্যদিকে মন দেওয়ার সময় নেই,” মেরিডিউ চেঁচিয়ে উঠলো। পিছনে ওদের পশ্চাদ্ধাবনকারীদের আওয়াজ চলে এসেছে খুব কাছে।
আবারও ভেসে এলো চিৎকার-একজন মহিলা প্রচণ্ড যন্ত্রণা পাচ্ছে বোঝা গেলো।
“আপনারা ফটকের দিকে যান,” মেরিডিউকে বললো ফ্রান্সিস। “আমি আসছি।”
সাথে সাথেই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ও ডানের সিঁড়ি বেয়ে দুদ্দাড় করে নেমে গেলো। সবাইকে ছেড়ে আসার মতো কোনো ব্যাখ্যা ওর কাছে নেই। কিন্তু সারাহ আর অ্যাগনেস এখানেই কোথাও আছে, আর ও ওদেরকে এভাবে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে পারবে না।