এখন সারাহকে বের করতে হবে। কিন্তু সারাহের কাছে ফিরে যাওয়ার আগেই একটা গা শিউরানো কান্নার আওয়াজে ভরে গেলো পুরো গুহা। কান্নার আওয়াজটা সারাহের। অ্যাগনেস দৌড়ে গেলো সেদিকে।
সারাহ মেঝেতে শুয়ে আছে, ওর মস্ত পেটের গায়ে হাঁটু চেপে ধরা, দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে একটা বল। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর, যেনো একটা প্রচণ্ড বেদনা চেপে রাখার চেষ্টা করছে।
কিন্তু বেশিক্ষণ পারলো না সারাহ। আবারও প্রচণ্ড ব্যথায় ডুকরে উঠলো। মাথাটা মেঝেতে বাড়ি খেলো, ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে। একটু পরে কেটে রক্ত বেরিয়ে আসলো।
অ্যাগনেস জানে ব্যথাটা কিসের। বোম্বেতে, আর পরে বিশ্লোয়ানেও ও মহিলাদের প্রসব বেদনার সময় সাথে থেকেছে। ওর কাজ ছিলো ডাক্তারকে সহায়তা করা। ও মহিলাদের হাত ধরে থাকতো, মুখ মুছিয়ে দিতো, আর কানে কানে উৎসাহ মূলক কথা বলে সান্ত্বনা দিতো। প্রায়ই ও নবজাতককে খুশিতে ঝলমল করতে থাকা মায়ের হাতে তুলে দিতে পেরেছে, আবার বেশ কয়েকবার পুরো কষ্টটাই বৃথা গিয়েছে।
পালানোর সব চিন্তা মাথা থেকে বেরিয়ে গেলো ওর। এখন আর সারাহকে নাড়ানো সম্ভব না। ও টান দিয়ে সারাহের পোশাক খুলে ফেললো। একদম সব। তারপর সেটাকে নোংরা মেঝের উপর বিছিয়ে দিলো। সারাহ কাপড়টার উপর মোচড়াতে লাগলো। ওর নগ্ন দেহের পুরোটা জুড়ে ঘাম জমে আছে। এই হালকা আলোতেও চিকচিক করছে তা।
চিৎকারের হার দ্রুত হতে লাগলো। অ্যাগনেস প্রতিবার ব্যথার মাঝের সময়টা গুণতে লাগলো। প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু সারাহ এখনো ধাক্কা দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত না-কিন্তু আর দেরিও করা সম্ভব না।
আরো কয়েকটা কামানের গর্জন ভেসে এলো পাথরের ভিতর দিয়ে। আর তারপরেই সিঁড়ি বেয়ে ছুটন্ত পদশব্দ নেমে আসতে শুনতে পেলো অ্যাগনেস।
*
“কি করবো আমরা?”
ফ্রান্সিস একবার সামনের বেড়া আর একবার পিছনে ধেয়ে আসা নৌকাগুলোর দিকে তাকালো। কি করবে সেটা ভাবারও সময় নেই হাতে। দ্রুত কাছিয়ে আসছে বেড়াটা।
“জাহাজের মুখ ঘোরাতে হবে,” মেরিডিউ বললো। “নইলে আমরাই ওদের কাজটা সহজ করে দিয়ে, নিজেরাই নিজেদেরকে ডুবিয়ে মারবো।”
“তাহলেতো আবার ঐ গ্রাবগুলোর মাঝে গিয়ে পড়তে হবে। ওরা আমাদেরকে বোমা মেরেই উড়িয়ে দেবে।”
“ওদিকে গেলে ঝুঁকি আছে মানছি, কিন্তু সোজা গেলে মৃত্যু একেবারে নিশ্চিত।”
ফ্রান্সিস উন্মাদের মতো চারপাশে তাকাতে লাগলো। তাতেই। আটকে গেলো বেড়ার শেষ মাথায়। এক প্রান্তে ওটা একটা ছোট্ট কেল্লায় গিয়ে মিশেছে। ওখান থেকে উপসাগরের শেষ প্রান্তটা পাহারা দেওয়া হয়। অপর প্রান্তে বেড়াটা সোজা দুর্গের পাদদেশে গিয়ে শেষ হয়েছে। অগ্নিকুণ্ডের আলোয় ওখানে একটা ছোট জেটি দেখতে পেলো ফ্রান্সিস। ওটার পরেই পাহাড়ের গায়ে একটা দরজাও দেখা গেলো।
“জাহাজের মুখ বাম দিকে ঘোরান,” আদেশ দিলো ও।
ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই মেরিডিউ জাহাজ ঘোরাতে আরম্ভ করে দিলো। কিন্তু মাথাটা ঘুরে যেতেই ফ্রান্সিস হুইলটা ধরে আবার আগের দিকে ঠেলে দিলো।
“জাহাজ পুরো ঘোরাতে হবে না,” ফ্রান্সিস বললো। “গাছের গুঁড়িগুলো যেখানে বাঁধা সেদিকের পাথর বরাবর চালান।”
“তাহলেতো টুকরো টুকরো হয়ে যাবে জাহাজ।”
ফ্রান্সিসের চেহারায় ছিটগ্রস্ত মানুষের মতো একটা হাসি ফুটে উঠলো। ওর ভিতরের অনিশ্চয়তাটা আর নেই; ও জানে যে এটাই ওর একমাত্র সুযোগ।
“আমরা ডাঙায় নামবো।”
ওদের জাহাজটা আগুয়ান নৌকাগুলোর সামনে আড়াআড়ি হয়ে, উপসাগরের মোহনা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। একদম সহজ নিশানা। বন্দুকের গুলি এসে জাহাজের পাশে লাগতে লাগলো। পাশের খোল ভেঙে ছিটকে পড়লো পানিতে। গালিভাতের দস্যুরা যখন টের পেলো যে জাহাজটা বেড়ার ফাঁদে আটকে গিয়েছে, তখন ওদের দাঁড়ের গতি আরো বেড়ে গেলো। যারা আগে জাহাজে উঠতে পারবে তাদেরকে আংরিয়া অতিরিক্ত পুরষ্কার দেবে।
“জেটির কাছে যাওয়ার আগেই যদি ওরা আমদেরকে ধরে ফেলে?” মেরিডিউ জিজ্ঞেস করলো। “ভাটার টান কমে গিয়েছে। আমাদেরকে এখন ধরে ফেলা পানির মতোই সহজ।”
“তাহলে আমরা সাঁতার দেবো।”
মেরিডিউ নিজের কপালে একটা চাপড় মেরে দড়াদড়িগুলোর দিকে দৌড়ে গিয়ে ওখানের লোকজনকে নির্দেশনা দিতে লাগলো। ও ওদেরকে নতুন লক্ষ্যের দিকে পাল ধরে রাখার কাজ দিয়েছে। যদিও পালটাতে অনেকগুলো ফুটো হয়ে গিয়েছে, তারপরেও কাজ হচ্ছে যথেষ্ট। ফ্রান্সিস বাকিদেরকে জাহাজের ভাঙা অংশগুলো কেটে পানিতে ভাসিয়ে দিতে বলেছে। ও চাচ্ছে জাহাজ যতোটা সম্ভব। জোরে ছোটাতে, সামনের পাহাড়ের দিকে যতোটা সম্ভব এগিয়ে যেতে চায় ও।
তবে এখন, আর এক দিক থেকে আক্রমণের শিকার হলো ওরা। জেটিতে থাকা দস্যুরা ওদেরকে আসতে দেখতে পেয়েছে, ফ্রান্সিসের উদ্দেশ্যও ধরতে পেরেছে। আগুনের আলোয় ফ্রান্সিস দেখতে পেলো আংরিয়ার লোকেরা সবাই হন্তদন্ত হয়ে, হাতের বল্লমগুলো দিয়ে কামানের মুখটা সোজা করার চেষ্টা করছে, যাতে জাহাজের দিকে গোলা ছুঁড়তে পারে। বাকিরা হাঁটু গেড়ে বসে বন্ধুক তাক করে ধরে আছে।
ফ্রান্সিস জাহাজের সামনের দুর্গ মতন জায়গাটার দিকে দৌড়ে গেলো। সামনের উঁচু আড়ালটার কারণে ওটায় মাস্কেটের গুলি ঢুকতে পারে না। দস্যুরা আবার পিস্তলে গুলি ভরার আগেই ও সবাইকেই ওটার পিছনে লুকিয়ে পড়তে বললো।