অ্যাগনেস আর সারাহ একা বসে আছে। প্রহরীরা খানিক আগে এদের লিডিয়াকে নিয়ে গিয়েছে। প্রতি সন্ধ্যাতেই কাজটা করে ওরা। প্রথমবার যখন এরকম হলো, অ্যাগনেস সে রাত পুরোটা জেগে ছিলো। আর বসে বসে ভাবছিলো দস্যুরা না জানি ওর উপর কি অত্যাচারটাই না করছে। কিন্তু লিডিয়া ফিরে আসার পর দেখা গেলো ও অ্যাগনেসের দুশ্চিন্তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না এমনকি দেখে মনে হলো যে ও বরং খুশি-ই হয়েছে। এটা থেকে, লিডিয়ার নির্লজ্জ কিছু কথা বার্তা থেকে অ্যাগনেস ধারণা করে নিয়েছে যে দস্যুদের মাঝ থেকে একজন প্রেমিক জুটিয়ে নিয়েছে।
এজন্যে ও লিডিয়াকে দোষ দেয় না। বেঁচে থাকার তাগিদে সবাই-ই সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। অ্যাগনেস কখনোই এরকম কিছু করতো না কিন্তু তাই বলে ও নিজেকে পুরোপুরি ভাগ্যের হাতেও সপে দেয়নি। অন্ধকারে বসে বসে ও ছোট একটা লোহার কাঠি দিয়ে নিজের হাতকড়ার তালা খোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। পাথরের মধ্যে গাঁথা অবস্থায় পেয়েছে ওটা। হয়তো কোনো এককালে ওখানে কোনো আঙটা ছিলো, সেটারই ধ্বংসাবশেষ। প্রায় এক সপ্তাহ লেগেছে. ওর ওটাকে দেয়াল থেকে খুলতে। চোখা মাথায় ঘষা খেয়ে বেশ কয়েকবার আঙুল কেটে রক্ত বেরিয়েছে কাজটা করতে হতো রাতে, যখন লিডিয়া চলে যেতো। কারণ ওর সামনে পড়লে ওর গোপন প্রেমিকের কাছে ফাস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো।
আজ ও কাজটা শেষ করতে পেরেছে। লিডিয়াও নেই, আর লোহার দরজাটার সামনে বসে থাকা প্রহরীরাও আজ চলে গিয়েছে। প্রথমে ও কারণ ভেবে পায়নি, তারপরেই কামানের গর্জন ভেসে এলো। আংরিয়া সম্ভবত ওদেরকে যুদ্ধ করতে ডেকে নিয়ে গিয়েছে। তাতে ও ভিতরে নতুন এক উদ্যম অনুভব করছে। অ্যাগনেস জানে না যে, টম আর ফ্রান্সিস দেয়ালের বাইরেই আছে, এমনকি ঐ মুহূর্তেই টম বিশাল একটা হাতীতে করে দরজার দিকে ধেয়ে আসছে। ও শুধু জানে যে দুর্গে আক্রমণ হয়েছে।
প্রায় বিশ বছর একজন সৈনিকের ঘর করেছে অ্যাগনেস। ও খুব ভালোমতোই জানে যদি দুর্গের পতন হয়, আর আক্রমণকারীরা এসে দুজন অসহায় নারীকে এভাবে বন্দী অবস্থায় পায়, তাহলে কি হবে।
ওর পাশেই সারাহ অস্ফুট গুঙিয়ে উঠে কাত হয়ে শুলো। ও এখন আর পাশ ফিরতে পারে না। ওর শুকিয়ে কাঠ হওয়া শরীর থেকে বেটপভাবে পেটটা ফুলে আছে। পেটের চামড়া এতো বেশি টানটান হয়ে আছে যে অ্যাগনেসের ভয় লাগে যে ফেটে যাবে যেকোনো সময়। বাচ্চা হওয়ার আর বেশি দেরি নেই। তাতে করে অ্যাগনেসের তাড়া আরো বেড়েছে। এই কয়েদখানায় যদি একটা বাচ্চা জন্ম নেয়, তাহলে এই দস্যুগুলো তাকে নিয়ে কি খেলা খেলবে সেটা অ্যাগনেস চিন্তা করতেও ভয় পাচ্ছে। নিজের আহত, প্রায় অবশ আঙুল দিয়ে ও লোহার ফালিটা হাতকড়ার ভিতরে খোঁচাতে লাগলো। প্রায় এক ঘণ্টা যাবত চেষ্টা করে যাচ্ছে। এদিক সেদিক সবদিকেই মুচড়িয়ে চেষ্টা করে দেখেছে। মাঝে মাঝে লোহার টুকরোটায় কিছু একটা আটকাচ্ছে, আর ওর মনে আশায় দুলে উঠছে। কিন্তু প্রতিবারই চাপ দিলে দেখা যাচ্ছে ওটা পিছলে সরে যাচ্ছে।
পাথরের ভিতর বেয়ে আসা শব্দের পরিমাণ আরও বাড়ছে। দেয়াল থেকে ঝুলি খসে পড়লো আরো খানিকটা। যুদ্ধ চরম অবস্থার দিকে চলে যাচ্ছে। মরিয়া হয়ে আবার ও লোহার টুকরোটা সজোরে চেপে ধরল তালার ফুটোয়। হাতের কাটা থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়লো তালার গায়ে। এতোক্ষণ ও আঙুল ভাঙার ভয়ে বেশি চাপ দেওয়ার সাহস করেনি। কিন্তু এখন আর কিছুর পরোয়া করলো না। দুর্বল বাহুর সব শক্তি আর এই কয়েক মাসের বন্দী জীবনের সমস্ত আক্রোশ জড়ো করে লোহার টুকরোটার উপর ঝুঁকে পড়লো বলা যায়।
খুলে গেলো তালা। কড়াটা ঝট করে খুলে পড়ে গেলো নিচে। হাঁটুতে লেগে ছিলে গেলো চামড়া ও কড়াটার দিকে তাকিয়ে রইলো, এখনো ওর অন্য হাতটা থেকে ঝুলছে। এখনো ওর পুরো বিষয়টা বিশ্বাস হচ্ছে না। বিগত কয়েক মাসের মধ্যে প্রথম ও নিজের কবজিটা দেখতে পেলো। ঘষায় ঘষায় ওখানকার চামড়া ছুলে গিয়ে কালো হয়ে আছে। ধরলেই ব্যথা করে।
কোনোমতে নিজের পায়ের উপর উঠে দাঁড়ালো ও! সারাহ তখনও ঘুমিয়ে আছে, এখুনি ওকে জাগানোর প্রয়োজন নেই। অ্যাগনেস পা টিপে টিপে গুহা থেকে বেরিয়ে লোহার দরজাটার কাছে চলে এলো। ওটার পরেই সিঁড়ি। ওখানেও তালা মারা-তবে সিঁড়ির গোড়ায়, দেয়ালে এক গোছা চাবি ঝোলানো আছে। বাইরে গোলগুলি শুরু হওয়ায় তাড়াহুড়ায় প্রহরীরা ওটাকে খেয়াল করেনি।
অ্যাগনেস হাত বাড়িয়ে নাগাল পেলো না। তবে তখনও ওর ডান কবজিতে হাতকড়াটা বাধা। ও গরাদের ফাঁক দিয়ে হাতটা বের করে দিলো। তারপর কড়ার খোলা প্রান্তটা মাছ ধরার জাল ফেলার মতো করে চাবির গোছার দিকে ছুঁড়ে দিলো।
কড়াটা চাবির গোছার সামান্য নিচে ঠকাস করে দেয়ালে বাড়ি খেলো। সিঁড়ি জুড়ে প্রতিধ্বনি উঠলো শব্দটার। ও আবারও চেষ্টা করলো কিন্তু কাজ হলো না।
এতোক্ষণে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ শুনে ফেলেছে–কিন্তু তাতে ওর যেনো জেদ আরো চেপে বসলো। ও এবার সময় নিয়ে তাক করে ছুঁড়ে দিলো কড়াটা।
এবার জায়গামতো লাগলো সেটা, আর গোছাটা দেয়াল থেকে খুলে শব্দ করে মাটিতে পড়ে গেলো। আবারও কড়াটা ব্যবহার করে ওটাকে টেনে কাছে। নিয়ে এলো অ্যাগনেস। তারপর সেটা তুলে নিয়ে চাবিটা তালায় লাগাতেই খুলে গেলো দরজা।