শহরের কোলাহলে ঘোড়াটা ভয় পেয়ে গেলো। লোকজনের হট্টগোল, পাথরের রাস্তায় গাড়ির ক্যাচকোচ শব্দ-নীরবতা নেই এক ফোঁটা। ফ্রান্সিস হাইপেরিয়নের উপর থেকে নেমে লাগাম ধরে টেনে নিয়ে চললো। সাথে কানে কানে ফিসফিস করে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। ব্যস্ত রাস্তায় বেশিরভাগ লোকই ওকে কোনো পাত্তা দিলো না, কিন্তু ওদের চোখের দৃষ্টি ফ্রান্সিসের নজর এড়ালো না। এক ভবঘুরে ছেলের সাথে এরকম সুন্দর একটা ঘোড়া-ব্যাপারটা সবার কাছেই সন্দেহজনক। সেটা বুঝতে পেরে ফ্রান্সিসের চেহারা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো; এর আগে কখনো ওর এতোটা একাকী লাগেনি।
অবশেষে একটা আস্তাবল খুঁজে পেলো ফ্রান্সিস। কিন্তু ওখানকার লোকটা ফ্রান্সিসকে এক নজর দেখেই ঘোষণা দিলো যে ওকে আগাম টাকা দিতে হবে। ভাড়া হচ্ছে পাঁচ শিলিং।
ফ্রান্সিস নিজের পকেট চাপড়ে বললো, “আমার কাছে কিছু নেই।”
“তাহলে আমারও কিছুই করার নেই।”
“প্লীজ।” রাত নেমে আসছে। এই ভয়ানক শহরে এভাবে চলার কথা মাথায় আসতেই ভয় লাগছে ফ্রান্সিসের। “আমি কালই আপনার টাকা দিয়ে দেবো।”
ধূর্ত চোখে ফ্রান্সিসকে আপাদমস্তক মাপলো লোকটা। ওর মরিয়া ভাবটা ভালোই টের পেয়েছে। “ঘোড়াটাকে বেচে দাও তাহলে।”
আতংকিত চোখে চেয়ে রইলো ফ্রান্সিস। প্রস্তাবটা বাতিল করতে মুখ খুললো, কিন্তু কথা বের হলো না। কারণ হঠাৎ খেয়াল হলো যে, ও যদি ভারতে নতুন জীবন শুরু করতে যায় তাহলে হাইপেরিয়নকে সাথে নিতে পারবে না।
চোখে পানি জমলো ফ্রান্সিসের কিন্তু সেটা পড়তে দিলো না।
“কতো দেবেন?”
“আমার জন্যে না। আমি দেখি কেনার মতো কাউকে পাই কিনা। ততোক্ষণ ও এখানেই থাক।”
ফ্রান্সিস ঘোড়াটার গলা জড়িয়ে ধরে কেশরে মুখ গুঁজে দিলো। হাইপেরিয়ন গরগর করে উঠলো। আস্তাবলের পরিচিত শব্দ আর গন্ধে আবার ভালো লাগছে ওর।
“রাতে থাকার জন্যে একটু জায়গা পাওয়া যাবে?”
লোকটা আবার ওর আপাদমস্তক তাকালো একবার। “চাইলে আস্তাবলে ঘুমাতে পারো।”
*
রাতে ফ্রান্সিসের ভালো ঘুম হলো না। ভোরেই উঠে পড়লো তাই। একটা পাত্র থেকে পানি নিয়ে যতোটা সম্ভব নিজেকে পরিষ্কার করে নিলো। ঘোড়ার গা পরিষ্কার করার ব্রাশ দিয়ে কাপড়ের কাদা পরিষ্কার করার চেষ্টা করলো কিন্তু কাজ হলো না বেশি একটা। ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দোকানের কাছে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে শুকনো হাসি ফুটলো ওর মুখে। চুলগুলো কাকের বাসার মতো.হয়ে আছে। চোখের চারপাশে বেগুনি দাগ, যেনো কেউ ঘুষি মেরেছে। গাল জুড়ে সদ্য গজানো দাড়ি। কাপড় ছিঁড়ে আছে এখানে সেখানে। আর কাদা না থাকলেও দাগ ঠিকই লেগে আছে সবখানে। ডান পায়ের জুতোর ছেঁড়া দিয়ে উঁকি দিচ্ছে আঙুল।
ফ্রান্সিস লন্ডনের অন্যতম সেরা ধনীর সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। স্যার নিকোলাস চিল্ডস-ই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে একটা ছোট সওদাগরী কোম্পানি থেকে অর্ধেক দুনিয়ার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী এক মহীরুহে রূপান্তরিত করেছেন। ফ্রান্সিস অনেক ছোট থাকতেই ওনার নাম শুনেছিলো। কিন্তু ওর সৎ বাবা যখনই ওনার প্রসঙ্গ তুলতেন ওর মা তখন অন্য ব্যাপারে কথা বলতেন।
ফ্রান্সিসের মনে হলো লন্ডনের প্রায় সবাই-ই লেডেনহল স্ট্রীট-এর বাড়িটাকে চেনে, তাই কোনদিকে যাবে সেটা বের করতে ওর কোনোরকম বেগই পেতে হলো না। প্রথম দর্শনে বাড়িটার খুব আলাদা কিছুই চোখে পড়বে না। কাঠের জানালা আর একজোড়া ভারী দরজা কৌতূহলী পথিকের দৃষ্টি থেকে বাড়িটাকে আড়াল করে রেখেছে; অলঙ্করণ বলতে আছে শুধু দরজার দুপাশে বিশাল দুটো থাম। তার পাশে একজন পোশাক পরা দারোয়ান দাঁড়ানো। কিন্তু যদি চোখ তুলে দেখা হয়, তাহলে অনেক বিস্তারিত ধরা পড়বে। তখন বোঝা যাবে যে আসলে ভবনটা কতোটা বিশাল। দোতলায় একটা কাঠের ব্যালকনি রাস্তা পর্যন্ত এসে পড়েছে। পিছনে কাঁচ ঘেরা বারান্দা। তার ঠিক উপরে, তিনতলায় একটা রাজকীয় প্রতীক সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। তার উপরে কার্ণিসে যতোদূর চোখ যায় ততোদূর একটা সমুদ্রে ভাসমান পালতোলা জাহাজের মুরাল আঁকা। জাহাজের পাশে ডলফিনেরা সাঁতরে বেড়াচ্ছে। ওটার মাঝে আছে রানি এলিজাবেথের একজন নাবিকের ভাস্কর্য। নাবিকটা লন্ডনের বাড়িগুলোর চুড়া আর চিমনীগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে।
জানা না থাকলে, প্রথম দর্শনে কারো মনে হতে পারে যে এটা বোধহয় জাহাজের জিনিসপত্রের দোকান। ভুল করে শহরের মাঝখানে দোকানটা দিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু আসলে জায়গাটা পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান কয়েকজন লোকের সদরদপ্তর।
ফ্রান্সিস ইতস্তত করতে লাগলো, সাহসে কুলাচ্ছে না। শেষমেশ দারোয়ানের দিকে আগালো ও।
“কষ্ট করে স্যার নিকোলাস চিল্ডসকে গিয়ে একটু বলবেন যে, ফ্রান্সিস কোর্টনী ওনার সাথে জরুরি কাজে দেখা করতে চায়।” উৎকণ্ঠায় স্বাভাবিকের চাইতে বেশি জোরে বলে ফেললো কথাগুলো। মনে মনে এরকম বাচ্চামির জন্যে মরমে মরে গেলো ফ্রান্সিস।
দারোয়ান ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। “স্যার নিকোলাস চিল্ডস আজ খুব ব্যস্ত। আর স্যার ফ্রান্সিস কোর্টনী তো সেই রাজা চার্লসের আমলেই মারা গিয়েছেন।”
“আমি ওনার নাতীর নাতী। একটু দয়া করুন, আমার স্যার নিকোলাসের সাথে দেখা করাটা জরুরি।” বলে ও ভারি দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলো। একটা শক্ত হাত ওর পথ আটকে দাঁড়ালো, তারপর ধাক্কা দিয়ে আবার পিছনে ঠেলে দিলো।