টমের বুকটা ছ্যাত করে উঠলো। পাহাড়ের মিনার থেকে দেখে মনে হচ্ছিলো, যে ফাঁকটা হয়েছে সেটা দিয়ে বেয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু এখন এই গোলাগুলির মাঝে দাঁড়িয়ে পুরো পাহাড়ের মতো লাগছে দেয়ালটা। শাহুজির সতর্কবার্তা মনে পড়লো, আমার গোলন্দাজদের আরো এক সপ্তাহ লাগবে।
কিন্তু এখন আর পিছু হটার উপায় নেই। দেয়ালের একটা অংশ টুকরো টুকরো না হয়ে, পুরোটা একসাথে ধ্বসে পড়েছে। নিচে পড়ে সুন্দর একটা আড়াল তৈরি করেছে সেটা। টম দৌড়ে গিয়ে ওটার পিছনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো।
পাশ দিয়ে সৈন্যরা দৌড়ে গেলো। ঘোশিয়ারা দেয়ালের কাছে যেতে গিয়ে ভয়ানকরকম আহত হতে লাগলো। কিন্তু তবুও দেখা গেলো লড়াইয়ের মানসিকতা একটুও কমছে না। বিড়ালের মতো করে লাফ দিয়ে পাথরের টুকরোগুলোর উপর উঠে দেয়ালের ভাঙা অংশটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।
টমের লজ্জিত বোধ হলো। বাকিরা যেখানে ওর পরিবারের জন্যে প্রাণ দিচ্ছে সেখানে ও এভাবে চোরের মতো লুকিয়ে থাকতে পারে না। পাগলামি ভর করলো যেনো ওর উপর। ঘোশিয়াদের মতো ওর রক্তেও বান ডাকলো পাগলামি। দেয়ালের টুকরোটার পিছন থেকে লাফ দিয়ে উঠে সামনে ছুটে গেলো ও। পায়ের ধাক্কায় টুকরো পাথর ছিটকে যেতে লাগলো; মাস্কেটের গুলি ছুটতে লাগলো চারপাশে। কিন্তু ওর মাথার ভিতর যে গর্জন চলছে তার আড়ালে চাপা পড়ে গেলো গুলির আওয়াজ।
দেয়ালের মাথায় উঠতে হবে, ওর মাথার ভিতর শুধু এটাই ঘুরছে। প্রায় পৌঁছেই গেলো সেখানে। এই দুর্গম পাথরের স্তূপের ভেতর দিয়ে আর মাত্র কয়েকটা ধাপ
কিন্তু ও যে পাথরটার উপর পা ফেললো সেটা সরে গেলো জায়গা থেকে। তারপর একগাদা টুকরো পাথর সমেত ঢাল বেয়ে পিছলে গেলো নিচে। দড়াম করে আছড়ে পড়ে গেলো টম। ফুসফুস থেকে সব বাতাস বেরিয়ে গেলো যেনো। ধুলো আর পাথরের চূর্ণে ভরে গেলো মুখ।
তবে ঘোশিয়ারা ওদের কাজ ঠিকই করে গেলো। ভগবান শিবের সহায়তায় দেয়ালের মাথায় পৌঁছে গেলো ওরা। আর ওদের দেখে দস্যুরাও ভয় পেয়ে গেলো। ফলে দুর্গের দিকে থেকে আসা গুলির পরিমাণ কমলো কিছুটা। ঘোশিয়ারা দেয়ালের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিজয় নৃত্য করতে লাগলো, সেই সাথে সেই পৈশাচিক কান্না তো আছেই।
কিন্তু সাথে সাথেই আর একটা গুরুগম্ভীর শব্দ পাওয়া গেলো। কামানের গর্জন। আংরিয়া জানতো যে মারাঠারা দেয়ালের ভাঙা জায়গাটার মাথায় উঠতে পারবেই, ও তাই ঠিক তার পিছনেই একটা কামান বসিয়ে রেখেছিলো। গোলার ভিতর ছিলো মাস্কেটের গুলি ভরা। দেয়ালের মাথায় যে-ই উঠুক তাকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত হয়ে ছিলো কামানগুলো।
টম এখনো নিচে কুঁকড়ে পড়ে আছে। আচমকা বজ্রপাতের মতো করে দেওয়ালের মাথায় ঝলসে উঠলো কামানের গোলাটা। দেয়ালের মাথার লোকগুলো মুহূর্তেই ভস্ম হয়ে গেলো ওর চোখের সামনে। টমের সারা শরীর শিউরে উঠলো তা দেখে। ওর আশে পাশে পোড়া মাংস আর টুকরো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এসে পড়তে লাগলো।
পা পিছলে না গেলে আমার অবস্থাও ওদের মতোই হতো। কিন্তু টমের এখন শুয়ে শুয়ে কৃতজ্ঞতা বোধ করার মতো সময় নেই। কামানে নতুন গোলা ভরার আগেই ওকে ওখানে পৌঁছাতে হবে।
নিজের তরবারিটা তুলে নিয়ে, লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঢালটা বেয়ে সোজা উপর উঠতে লাগলো টম। পাথর থেকে পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে লাগলো ও। খুব দ্রুত, যাতে আগের বারের মতো পা পিছলে না যায়।
পাথরের স্তূপের ঢালের ঠিক নিচে একটা শোরগোল শোনা গেলো। প্রথমে একজন একটা শ্লোগান দিচ্ছে, তারপর বাকি সবাইও তাল দিচ্ছে। “হর! হর! মহাদেব!” ওর পিছনের লোকজন প্রথমে কামানের গোলার আওয়াজে ঘাবড়ে গিয়েছিলো। তবে এখন আবার নতুন করে জড়ো হচ্ছে। টমের পিছু পিছু মারাঠাদের রণহুংকার ছাড়তে ছাড়তে ধেয়ে এলো ওরা। যাদের হাতের অস্ত্র পড়ে গিয়েছিলো, তারা হাতে পাথর তুলে নিয়ে ছুটে এলো। সামনে কোনো দস্যু পড়লে ওটা দিয়েই থেতলে দিতে লাগলো। সামনের কামানের। আশেপাশে যেসব দস্যু জড়ো হয়েছিলো, তাদেরকে হাতের বল্লম ছুঁড়ে মারা হলো। টম এক দৌড়ে ঢাল বেয়ে সোজা উপরে উঠে দেয়ালের ভাঙা অংশটায় গিয়ে থামলো। মোহিত ছিলো ওর এক পা পিছনেই। একজন দস্যু বেয়নেট হাতে দৌড়ে এলো, কিন্তু ও হাতের জৈত্রিটা দিয়ে এক বাড়িতে তার মাথাটা তরমুজের মতো ফাটিয়ে দিলো।
এক মুহূর্তের জন্যে ভাঙা দেয়ালটার উপরে দাঁড়িয়ে রইলো ওরা। ওদের দুই পাশে দুর্গের দুটো মিনার। সামনের চত্বরে অনেকগুলো মশাল আর বাতি জ্বলছে। টম ঠোঁট চাটলো, চেহারায় লেগে থাকা হলুদের তিক্ত স্বাদ এসে লাগলো জিহ্বায়।
তারপর ও আকাশের দিকে অস্ত্র তুলে জয়ধ্বনি করে উঠলো। সাথের লোকদের মতোই হুঙ্কার ছেড়ে বললো, “হর! হর! মহাদেব! ঈশ্বর আমাদের সহায়।”
ওরা দুর্গের ভিতরে ঢুকে পড়েছে, এখন ওকে সারাহ আর অ্যাগনেসকে খুঁজে বের করতে হবে।
*
যুদ্ধের হট্টগোল পাথর বেয়ে নিচের কয়েদখানাতেও শোনা যাচ্ছে। কামানের গোলার প্রচণ্ড শব্দ বা গোলা আছড়ে পড়ার সময়কার গর্জন, দুটোই কয়েকগুণ বর্ধিত হয়ে ওদের কানে এসে লাগছে। সেগুলোর কাপনে ধুলো আর টুকরো পাথর খসে পড়ছে দেয়াল থেকে। ওদের মনে হতে লাগলো কোনো অতিকায় দানবের পেটের ভিতর আটকা পড়েছে যেনো।