শাহুজি ওর চিন্তা ধরতে পারলেন। “সবাইকে জানতে হবে যে ওদের সেনাপতি ওদের সাথেই আছেন,” নরম গলায় বললেন উনি। “যদি ওরা আপনাকে দেখতে না পায়, তাহলে ভাবতে পারে যে আপনি যুদ্ধ থেকে পালিয়েছেন। আর আপনি যদি যুদ্ধ না করেন, তাহলে ওরা কেনো করবে?”
নিচের উপসাগর থেকে আরো কয়েকটা কামানের গর্জন শোনা গেলো। টম নিজের শরীরে সৈন্যদলের প্রত্যেকের দৃষ্টি অনুভব করতে পারলো। এখন আর তর্কের সময় নেই।
“আপনি যতোটা ভাবছেন তার চাইতে নিরাপদ এটা,” শাহুজি বললেন। “শিকারের হাতী আর যুদ্ধের হাতী আলাদা।”
মাহুত হাতীটাকে বসিয়ে দিতেই টম উঠে গেলো পিঠে। শাহুজির কথাটার মর্মার্থ ধরতে পারলে সাথে সাথেই। বাঘ শিকারে যেরকম নকশা কাটা হাওড়া ব্যবহার করা হয়েছিলো, সেগুলো আর নেই। এখানে আছে একটা বর্মাচ্ছাদিত বক্স। চারপাশে লোহার পাত। তার সামনে একটা হালকা কামান বসানো।
মোহিত চড়লো ওর পিছনে, মাহুত বসলো বক্সের সামনে। নিচে তাকিয়ে টম দেখলো সৈন্যদলও ওদের পাশে হাঁটা শুরু করেছে। একদম সামনের সারির সৈন্যগুলো পুরো নগ্ন। ওদের সারা গায়ে ছাই মাখা, চুল ছিঁড়ে এলোমেলো করে রেখেছে। হাঁটার সময় মোচড় খেয়ে প্রায় লুটিয় পড়তে লাগলো মাটিতে। ছাই মাখা দেহটা দেখে মনে হতে লাগলো যেনো ধোয়া উড়ে যাচ্ছে রাতের আকাশে।
“এরা কারা?” মোহিতকে জিজ্ঞেস করলো টম।
“ঘোসিয়া,” জবাব দিলো হাবিলদার। “এরা হচ্ছে অস্পৃশ্য। ধ্বংসের দেবতা শিবের আরাধক। উন্মাদ কতগুলো, কিছুই ভয় করে না।”
ওদের গলায় একটা নিনাদ শোনা গেলো; এক পৈশাচিক কান্নার সুর, যা শুনে কপালে ঘাম জমে গেলো টমের। একটু পর ঘোশিয়ারা ওদের তরবারির ফলা দিয়ে বুক চাপড়াতে লাগলো।
“আংরিয়া আমাদের আসার শব্দ পেয়ে যাবে,” টম বিরক্ত হলো।
“আপনি ওদেরকে থামাতে পারবেন না, মোহিত বললো। এর মধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে।”
ওদের সামনের দল ততোক্ষণে গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে এসে শৈল অন্তরীপটা সংযোগকারী চিকন ভূমিটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নিচে উপসাগরের আগুনের আলো কমে এসেছে। ভৌতিক একটা আভা ছড়াচ্ছে ওগুলো থেকে। হাতীর পিঠ থেকে নিচে দেখতে পেলো টম। লড়াই জমে উঠেছে। একটা বড় গ্রাবকে দেখা গেলো অন্য জাহাজগুলো থেকে আলাদা হয়ে সমুদ্রের দিকে ছুটে যাচ্ছে। আর একটায় আগুন ধরে গিয়েছে। ফ্রান্সিসের নৌকাগুলো চোখে পড়লো না ওর-তবে পুরো পানি ভরে আছে ভাঙা কাঠের টুকরো আর মরা লাশে।
একটা মাস্কেটের গুলি এসে সামনের লোহার পাতে লাগতেই টুং করে ঘণ্টার মতো আওয়াজ হলো। টম শাপ শাপান্ত করতে করতে মাথা নিচু করে ফেললো। ওরা এর মধ্যেই ওদের নাগালের ভিতরে চলে এসেছে। আংরিয়ার লোকজন ঘুমাচ্ছিলো না। ওরা মারাঠাদেরকে এগিয়ে আসতে দেখে দ্রুত আত্মরক্ষা শুরু করেছে। ঐ সরু এক চিলতে জায়গা বরাবর সমানে গুলি করে যাচ্ছে, ওরা। মারাঠা সৈন্যদের মাঝে কামানের গোলা এসে পড়লো। টম, একজন ঘোশিয়াকে খেয়াল করলো, তখনও উন্মাদের মতো নেচেই যাচ্ছে। কামানের গোলা খেয়ে সে সোজা উড়ে গিয়ে পড়লো পিছনের লোকগুলোর ভিতরে। ওর সাথীরা তাতে না দমে, উল্টো গর্জন ছেড়ে সামনের দিকে দৌড় দিলো।
একটা কসাইখানা হয়ে গেলো সরু জায়গাটা। টমের চারপাশে মুড়ির মতো মরতে লাগলো মানুষ। একটা কামানের গোলা ওর হাতীর মাথার মাত্র কয়েক ফুট সামনে পড়লো। জানোয়ারটা কান ঝাড়া দিলো একবার, তারপর মাথা নিচু করে সামনে ধেয়ে গেলো। মাস্কেটের গুলি এসে লাগলো ওটার গায়ে, কিন্তু তেমন কোনো ক্ষতি হলো না। আফ্রিকার অভিজ্ঞতা থেকে টম জানে খুব কাছ থেকে গুলি করার পরেও, একটা গুলি শুধু হাতীর গায়ের ধুলো ঝাড়া বাদে আর কোনো ক্ষতিই করতে পারে না।
কিন্তু গুলি খাওয়ায় রেগে গেলো হাতীগুলো। সজোরে সামনে ধেয়ে গেলো ওগুলো। আর ওটার পিঠে হাওড়াটা বিক্ষুব্ধ সাগরে ভাসমান একটা নৌকার মতো দুলতে লাগলো। হাতীর বিশাল একেকটা পদক্ষেপে প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগলো হাওড়াটা। গতির চোটে টমের কানের পাশ দিয়ে শো শো করে বাতাস বইছে। সেই সাথে গুলির তোড়ে লোহার পাতে টুংটাং আওয়াজ চলছেই। টম যা ভেবেছিলো সেটাই হয়েছে, সবাই সহজেই ওকে নিশানা করতে পারছে। দস্যুরা জানে যে টম কোথায় আছে, কিন্তু জানোয়ারটার বিশাল আকৃতি ওর জন্যে একটা সুরক্ষার কাজ করছে। মারাঠারাও জানোয়ারটার পিছনে লুকিয়েছে। দেয়ালের উপরের দস্যুগুলোর, হাত থেকে হাতীটার দেহ সবার জন্যে একটা সুরক্ষা প্রাচীরের কাজ করছে। হাতীটা দেয়ালের কাছের কাঁটা ঝোঁপ মাড়িয়ে ছুটে গেলো, ফলে মাঝখান দিয়ে পথ হয়ে গেলো একটা।
হাতীটার গতি কমে এলো। টম বক্সের কিনারা দিয়ে ভয়ে ভয়ে মাথা তুলে দেখলো ওরা ঠিক দেয়ালের সামনে চলে এসেছে। তবে তার জন্যে চড়া দামও দিতে হয়েছে। পুরো শৈল অন্তরীপটা জুড়ে শুধু লাশ আর লাশ।
কামানগুলোর গর্জন থেমে গিয়েছে, কিন্তু মাস্কেটের গর্জন এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। দেয়ালের দস্যুগুলো এখন প্রায় সরাসরি হাতীটার উপরে। টম বক্স থেকে লাফিয়ে হাতীর গা বেয়ে পিছলে নেমে এলো। ডানে তাকিয়ে দেখে ফটক থেকে গজাল বেরিয়ে আছে। এতো লম্বা যে এই হাতীটার চাইতেও বড় জানোয়ারকে থামিয়ে দিতে পারবে। আর সামনে দেয়ালের যে অংশটা ভেঙেছে সেখানে পাথরের টুকরো স্তূপ হয়ে জমে আছে।