ফ্রান্সিস একটা বাতি জ্বালিয়ে দ্রুত হাতে ঘোড়ার পিঠে কম্বল চাপালো। দেওয়ানের লোকজন কিছুক্ষণ পরেই পিছন দিক দিয়ে বাড়িতে ঢোকা যায় কিনা সেটা খুঁজতে চলে আসবে। ও দেয়ালে ঝোলানো একটা পানিরোধী কাপড় কাঁধে চাপিয়ে হাইপেরিয়নকে উঠোনে নিয়ে এলো।
একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, ওর জন্যেই অপেক্ষা করছে।
“মা?” এলিসকে দেখা মাত্র ফ্রান্সিসের রাগ পানি হয়ে গেলো, আস্তাবলের ছায়ায় ওনাকে ভূতের মতো লাগছে। ওনার শুকিয়ে যাওয়া শরীরে ঝুলতে থাকা কাপড় বেয়ে পানি ঝরছে, যেনো একটা বাচ্চা মেয়ে বৃষ্টিতে পথ হারিয়ে ফেলেছে। ওনার হাতে একটা ছোট ভেলভেটের ব্যাগ।
“বিদায় না বলেই তোমাকে ছাড়ি কিভাবে বলো?”
ফ্রান্সিস–কে জড়িয়ে ধরলো। “গুডবাই মা।”
“কোথায় যাবে তুমি?” ঝড়ের কারণে ফ্রান্সিসের কানের কাছে মুখ নিয়ে চেঁচাতে হচ্ছে এলিসের।
ফ্রান্সিসের মাথায় চিন্তাটা আগে আসেনি। কিন্ত আসামত্র ও উত্তরটা পেয়ে গেলো।
“দুনিয়াতে পরিবার বলতে আমার আর আছে গাই চাচা। উনিতো এখন আছে বোম্বেতে। আমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লন্ডন অফিসে যাবো। গিয়ে একটা চাকরি আর ওদের জাহাজে করে ভারতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে বলবো।” ফ্রান্সিস বিশাল বাড়িটার দিকে তাকালো। কতো শত স্মৃতিতে ভরপুর। “একদিন অনেক টাকা কামিয়ে আবার ফিরে আসবো। আবার হাই উইল্ডকে ফিরিয়ে নেবো।”
এলিস হাতের আঙুলে ঝোলানো ভেলভেটের ব্যাগটাকে আঁকড়ে ধরলেন। প্রাণপণ চেষ্টা করছেন নিজের একমাত্র ছেলেকে বিদায় দেওয়ার ব্যথাকে চাপতে।
“ভালোই বলেছো। গাই চাচার সাথে সাবধানে থাকবে। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে ওদের বোর্ড অফ ডিরেক্টরেরা বাদে তুমি হচ্ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সবচেয়ে বড় শেয়ার হোল্ডার। মাত্র দুই বছর বয়সেই তুমি এটার মালিক হয়েছিলে। তোমার দাদা হাল বিশ হাজারেরও বেশি শেয়ার কিনেছিলেন। আর উইলিয়াম এতো কম বয়সে মারা যাওয়ার পরে তুমিই ছিলে ওগুলোর মালিক। ওগুলোকে একটা ট্রাস্টের মাধ্যমে রেখে দেওয়া যেতো। কিন্তু গাই বলেছিলো ওগুলো বিক্রি করে দিতে। আমি ওর কথাই শুনি। কিন্তু আমার মনে সন্দেহ যে আসলেই আমাদেরকে আমাদের ন্যায্য পাওনা দেওয়া হয়েছিলো কিনা। আমরা যদি শেয়ারগুলো ট্রাস্টে রাখতাম তাহলে ওয়াল্টার কখনোই ওগুলোর নাগাল পেতো না। ওগুলোকে নগদ টাকায় ভাঙ্গানোর পরেই…”
এলিস দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। উইলিয়াম যেমন মানুষই হোক না কেনো, ও। মারা যাওয়ার পর এলিস ছিলেন ইংল্যান্ডের সবচেয়ে ধনী বিধাব। কিন্তু বিগত পনেরো বছর ধরে সেই সম্পত্তিকে তার সদ্য প্রয়াত স্বামী ঋণ আর কর্জের বোঝা বানিয়ে ফেলেছে। কোন মুখে উনি ফ্রান্সিসকে থেকে যেতে বলবেন? ওর জন্যে এখানে কিছুই নেই। স্যার ওয়াল্টার সব খেয়ে দিয়েছেন।
“এটা নাও।” বলে উনি ভেলভেটের ব্যাগটা বাড়িয়ে দিলেন। বৃষ্টিতে কাপড়টা ভিজে গিয়েছে কিন্তু ফ্রান্সিস হাতে নিয়েই বুঝলো যে ভিতরে শক্ত কিছু একটা আছে। ও ব্যাগটা খুললো।
বিগত কয়েক মাসের দারিদ্রের পরে ভিতরের দৃশ্যটা একেবারে স্বর্গীয় বলা চলে। আস্তাবলের মশালের আলোয় ও দেখতে পেলো জিনিসটা একটা সোনার পদক। ঝকড়া কেশরওয়ালা একটা সিংহ খোদাই করা আছে তাতে। সিংহটা নিজের পায়ের থাবায় পুরো পৃথিবীকে ধরে রেখেছে। আর উপরের মীনা করা নীল আকাশ থেকে হীরার তারা আলো ছড়াচ্ছে।
“কি এটা?”
“দ্য অর্ডার অফ দ্য সেন্ট জর্জ অ্যান্ড হলি গ্রেইল। কোর্টনীরা বংশ পরম্পরায় এটা গলায় পরে। এটার মালিক এখন তুমি।”
“কিন্তু…” ফ্রান্সিস ইতস্তত করতে লাগলো। যেনো একজন ক্ষুধার্ত লোককে একগাদা খাবারের সামনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। “এরতে বিশাল দাম। শুধুমাত্র হীরাগুলোইতো… এটা বেঁচেই তো আমরা হাই উইল্ড রেখে দিতে পারি।”
“না।” ওর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে বললেন এলিস। “এটা কোর্টনীদের ইজ্জতের ব্যাপার। যেখানেই যাও, যা-ই করো, এটা কখনো যেনো হাতছাড়া না হয়।”
কাছেই চিৎকার শোনা গেলো। বাড়ির পাশ থেকেই। এলিস ফ্রান্সিসের হাত ধরে কপালে চুমু খেলেন।
“যাও। লন্ডনে গিয়ে স্যার নিকোলাস চিন্ডস এর সাথে দেখা করবে। উনি তোমার দাদার বন্ধু ছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে ওনার প্রভাব এখনো অনেক। যদি কেউ তোমাকে সাহায্য করতে পারেন তো উনিই পারবেন।”
*
ছোট থাকতে ফ্রান্সিস অনেকবার লন্ডন এসেছে। কিন্তু সবসময়েই সাথে ওর বাবা মা ছিলেন। ঘোড়ার গাড়িতে করে ঘুরতো ওরা। কোচোয়ান চাবুক দিয়ে বাতাসে সপাং করে বাড়ি দিয়ে সামনের লোকদের সরিয়ে দিতে। সাথে একটা চাকরও থাকতো যে প্রতিটা থামার জায়গায় কিছু লাগলে এনে দিতো। আর এবার লন্ডন যেতে লাগলো প্রায় এক সপ্তাহ। ভাঙাচোরা রাস্তা আর শরতের ভ্যাপসা গরমে নাভিশ্বাস উঠে গেলো ওর। রাত কাটালো কোনো খানা খন্দের ভিতরে। হাইপেরিয়নকে বেঁধে রাখতো ঝোঁপের আড়ালে যাতে কারো চোখে না পড়ে। কারণ সবসময় দুশ্চিন্তা হতো যে কোনো শয়তানের কবলে পড়ে ও জামার নিচে লুকানো লাল ভেলভেটের ব্যাগটা হারিয়ে ফেলবে। স্যালিসবুরি পৌঁছার পর এক সকালে ওর ঘুম ভাঙলো শেরিফের লোকজনের ডাকে। ওরা ওকে ঘোড়া চোর মনে করে ধাওয়া দিলো। বেশ কয়েকটা মাঠ পেরিয়ে এসে তারপর পালাতে সক্ষম হলো ফ্রান্সিস। রিচমন্ড পৌঁছে, সাথে থাকা শেষ কয়েকটা মুদ্রা দিয়ে ও হাইপেরিয়নের জন্যে এক ব্যাগ ওট আর নিজের জন্যে এক মগ বিয়ার কিনলো। লন্ডন পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘোড়াটা প্রায় পঙ্গু হওয়ার জোগাড় হলো। আর ফ্রান্সিসও দেখা গেলো ময়লা-কাদা মেখে ভূত হয়ে গিয়েছে।