“আমাদেরকে যেতে হবে,” করুণ সুরে বললো ফ্রান্সিস। ও আবার ওর মাকে টেনে দাঁড় করিয়ে উপরের তলায় নিয়ে গেলো। যাওয়ার পথে সদর দরজা বন্ধ করে দিতে ভুললো না। এলিসের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে, হাত পা ঠাণ্ডা। “তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও, যা যা নেওয়া সম্ভব সব নাও।”
অবসন্ন ভঙ্গিতে এগিয়ে গিয়ে দেরাজ খুলে কয়েকটা পোশাক বের করলেন এলিস। ফ্রান্সিস নিজের ঘরে গিয়ে নিজের যৎসামান্য যা আছে তা একটা ব্যাগে ভরে নিলো। প্রতিটা সেকেন্ড পার হওয়াটা অনুভব করতে পারছে ও।
আবার মায়ের ঘরে ফিরে এসে দেখে বিছানা জুড়ে কাপড় ছড়িয়ে উনি চুপচাপ বসে আছেন।
“কি ব্যাপার?” রেগে গেলো ফ্রান্সিস। “ওরা যে কোনো মুহূর্তে চলে আসবে এখানে।” বলতে বলতে নিজেই মায়ের কাপড় একটা ব্যাগে ভরতে শুরু করলো। “যদি আজ আমার বাবা
“ওনাকে ওই নামে ডাকবে না,” ফিসফিস করে বললেন এলিস। “স্যার ওয়াল্টার তোমার বাবা নন।”
“আমি জানি। কিন্তু তুমিই বলেছো যে আমার তাকে-”
“ভুল করেছি আমি। আমি ওনাকে বিয়ে করেছিলাম কারণ আমি ছিলাম এক বিধাব আর তোমার একজন বাবার দরকার ছিলো। উইলিয়াম মারা যাওয়ার পরে আমার পরিবার আমাকে ত্যাজ্য করে দেয়; ওরা এমনকি ওর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতেও আসেনি। অভিজাত পরিবারগুলোর বাইরের একজন সাধারণ লোককে বিয়ে করার জন্যে বাবা আমাকে খুবই অপছন্দ করতেন। অথচ কোর্টনীদের আমাদের চাইতেও বেশি টাকা পয়সা ছিলো। এরপর উইলিয়াম মারা গেলো, আর মারা যাওয়া নিয়ে যেসব গুজব শোনা যেতে লাগলো… বাবা আমাকে কখনোই ক্ষমা করেননি।”
“এসব তো আগে বলোনি।”
“তুমিতো ছিলে একটা দুধের বাচ্চা। এমনিতেই কতো কষ্ট পেয়েছো তুমি। স্যার ওয়াল্টার লেইটন ছিলেন দারুণ একজন মানুষ। খুব মজা করতে পারতেন। কিন্তু আমি ওনার আসল রূপটা ধরতে পারিনি। ঠিক যেমন আমি তোমার বাবাকেও চিনতে ভুল করেছিলাম। যখন বুঝেছি ততোদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।”
“কিন্তু তুমি সবসময় বলেছো যে আমার বাবা, মানে আমার আসল বাবা, উইলিয়াম কোর্টনী ছিলেন ভালো মানুষ। একজন দয়ালু মহৎ লোক।”
এলিসের চেহারায় ভাঁজ পড়লো। “ওহ ফ্রান্সিস, সবই ছিলো মিথ্যে। উইলিয়াম কোর্টনী কেমন মানুষ ছিলো সেটা জানলে তুমি কতটা কষ্ট পাবে সেই ভয়েই আমি কিছু বলতে সাহস করিনি। ও ছিলো একটা কুৎসিত মনের নরপশু। নিজের বাবা মারা যাওয়ার পর ও খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলো; আমার উপর অকথ্য অত্যাচার করেছে, বেঁচে থাকলে তোমার উপরেও করতো। ও নিজের আপন ভাই টমাসকে প্রায় মেরেই ফেলেছিলো।”
ফ্রান্সিসের মনে হলো পায়ে কোনো বল পাচ্ছে না। ও ধপ করে বিছানার উপর বসে পড়লো। রাগের চোটে চোখে পানি এসে গেলো ওর। “না। আমিতো জানি টমাস ওনাকে খুন করেছেন। তুমিই বলেছো মা। তুমি নিজে বলেছো।”
“সেটা সত্যি। টম উইলিয়ামকে মেরেছে,” স্বীকার করলো এলিস। “কিন্তু সেটা আত্মরক্ষা করতে গিয়ে।”
“তুমি সেখানে ছিলে?” টম জোর দিয়ে বললো। “নিজের চোখে দেখেছো?”
“উইলিয়াম লন্ডনে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। টম ওকে খুন করেছে এমন খবর চাউর হয়ে যায়। কিন্তু আমি জানি টম যদি ওকে আসলেই খুন করে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই ওকে আগে উসকে দেওয়া হয়েছে। ঠাণ্ডা মাথায় নিজের আপন ভাইকে খুন করার লোক টম না।”
ফ্রান্সিসের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগলো। কিন্তু আসলে উনি সেটাই।”
আচমকা নিচে করাঘাত শোনা গেলো। মাপা কিন্তু যথেষ্ট শক্তিশালী। শব্দটা কিসের সেটা ধরতে এবার আর কোনো কষ্ট হলো না। ভারী দরজায় শক্তিশালী একটা হাতের আঘাত। ফ্রান্সিস চাপা আওয়াজ শুনতে পেলো। কেউ একজন দরজার হাতল ঘোরানোর চেষ্টা করতে লাগলো।
এলিস ফ্রান্সিসকে আঁকড়ে ধরলেন। “তুমি এখন বড় হয়েছে। সত্যিটা এখন তোমার জানা দরকার।”
“মিথ্যা বলছো তুমি।” ও ঝাড়ি মেরে এলিসের হাত ছুটিয়ে দিয়ে তার ব্যাগ তুলে নিলো। আবারও দরজায় জোরে জোরে করাঘাতের আওয়াজ পাওয়া গেলো। আমি আজ রাতে একটা বাবাকে হারিয়েছি। আর এখন তুমি বাকিজনেরও স্মৃতি নষ্ট করে দিচ্ছো।”
“দরজা খুলুন,” একটা ভারি গলা শোনা গেলো। এই ঝড়ের মাঝেও স্পষ্ট। “আমরা আইনের লোক।”
ফ্রান্সিস দরজার কাছে এগিয়ে গেলো। “আমাদের যেতে হবে। ওরা আমাদেরকে এখানে পেলে সব কিছু নিয়ে নেবে।”
“আমি যাবো না,” গায়ের শালটা আরো ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বললেন এলিস। “ওরা নিশ্চয়ই একজন গরীব বিধবাকে এভাবে বাড়িছাড়া করবে না। আর ওয়াল্টার যেহেতু মারা গিয়েছে, তার মানে এতো সহজে ওড়া ওর ঋণের শোধ পাবে না। যদি ওরা বাড়িটা নিতে চায় তো নিক। এই বাড়িটায় আমার একমাত্র আনন্দ হচ্ছে তোমার জন্ম। এটা বাদে বাড়িটায় শুধু দুঃখই পেয়েছি।”
ফ্রান্সিস এলিসের দিকে তাকিয়ে রইলো। আবেগা দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর; অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু গলা দিয়ে কোনো স্বর বের হলো না।
“দরজা খুলুন,” নিচ থেকে হাক শোনা গেলো আবার।
ফ্রান্সিস দৌড় দিলো। পিছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে রান্নাঘর পেরিয়ে উঠোনে চলে এলো ও। আস্তাবলের সব কর্মচারীকে অনেক আগেই ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে; ও যেসব ঘোড়ার শাবকে চড়ে বড় হয়েছে সেসবকেও বহু আগেই নয়ন মালিকের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। শুধু একটা ঘোড়াই বাকি আছে-নাম হাইপেরিয়ন। তেরোতম জন্মদিনে ওর সৎ বাবা ওকে এই উজ্জ্বল বাদামী ঘোড়াটা উপহার দিয়েছিলো। ফ্রান্সিসের পদধ্বনি শুনে ঘোড়াটা মৃদু হ্রেষা ধ্বনি করে উঠলো।