দ্রুত হাতে তালা খুলে দরজাটা খুলে ফেললো ফ্রান্সিস। রুমের ভিতর আগাতেই মোমের আলোয় ছায়াগুলো বিচিত্র নকশা করে সরে যেতে লাগলো। ছোট বেলায় ও এখানকার মসৃণ মেঝেয় পিছলা খেতো। কিন্তু এখন মেঝেটা অমসৃণ আর জায়গায় জায়গায় চলটা উঠে গিয়েছে; বহু বছর হয় পালিশ করা হয় না। দেয়াল জুড়ে সারি সারি খালি বইয়ের তাক; বাকি সব কিছুর মতো বইগুলোও বেঁচে দেওয়া হয়েছে। একসময় যেখানে তরবারি আর ঢাল ঝোলানো থাকতো সেখানের প্লাস্টারে দাগ হয়ে আছে। কোর্টনীদের শৌর্য বীর্যের প্রতীক ছিলো সেগুলো। রূপা আর কাঁচের তৈজসপত্রের মতো ওগুলোও বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
ঘরের একদম শেষ মাথায় একটা বিশাল ওকে কাঠের টেবিল। একগাদা কাগজ আর খালি ওয়াইনের বোতল দেখা যাচ্ছে ওটার উপর। কোনো গ্লাস বা আর কোনো পাত্র নেই। ওর বাবা আলুথালুভাবে ওটার পেছনে চেয়ারে বসে আছেন। যেনো ক্লান্ত হয়ে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন। কাগজপত্রের উপরে লাল রঙের একটা তরলে ভরে আছে।
ফ্রান্সিস থমকে দাঁড়ালো। তারপর আচমকা দৌড় মেরে অবয়বটার কাছে। পৌঁছে সেটাকে টেনে সোজা করলো। কিন্তু ছেড়ে দিতেই দেহটা টেবিলের উপর পড়ে টেবিল শুদ্ধ উলটে পড়ে গেলো। ওর বাবা মেঝের উপর আছড়ে পড়ে একদিকে কাত হয়ে গেলেন। একটা হাত থেকে পিস্তল খসে পড়লো।
সারা শরীর কাঁপিয়ে বমি পেলো ফ্রান্সিসের। বহু কষ্টে সামলালো ও সেটা। “বাবা?”
স্যার ওয়াল্টার লেইটন একসময় বেশ সুপুরুষ ছিলেন। কিন্তু মাদকের নেশা তার সব শেষ করে দিয়েছে। এমনকি মারা যাওয়ার পরেও তার চেহারায় এক অদম্য শক্তিমত্তার ভাব ফুটে আছে। ছোট বেলার কথা মনে পড়লো ফ্রান্সিসের। বাবা ওকে বাতাসে ছুঁড়ে মেরে আবার ধরে ফেলতেন, ঘোড়ায় চড়ে বেড়া ডিঙ্গাতে পারলে একটা স্বর্ণমুদ্রা বখশিশ দিতেন, বলা নেই কওয়া নেই লন্ডনে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। এখন তার নিষ্প্রাণ নীল চোখ জোড়া ওর দিকে তাকিয়ে আছে, যেন ওর কাছে ক্ষমা চাইছে। সামনের দিক থেকে তাকালে আঘাতের কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। শুধু ভালো করে খেয়াল করলেই কপালের উপরের দিকের ক্ষতটা চোখে পড়ে, যেখান দিয়ে পিস্তলের গুলি তার ঘিলুকে পিছন দিয়ে বের করে দিয়েছে।
পিছনে একটা খনখনে চিৎকারে সম্বিত ফিরলো ফ্রান্সিসের। ও ঘুরে তাকালো সেদিকে। এলিস দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে। মুখে হাত চাপা দেওয়া। মেঝেতে পড়ে থাকা লাশটার দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন।
“তোমাকে বলেছিলাম উপরেই থাকতে,” ফ্রান্সিস বললো। ওনাকে এই দৃশ্য দেখতে দিতে চায়নি মোটেও। ও দ্রুত এগিয়ে এলিসকে জড়িয়ে ধরলো। মুখটা নিজের কাঁধে চেপে ধরলো যাতে ভয়াবহ দৃশটা তাকে দেখতে না হয়।
এলিস ফোঁপাতে ফোঁপাতে জিজ্ঞেস করলেন, “এরকম কেনো করলেন উনি?”
ফ্রান্সিস এলিসকে একটা চামড়ার চেয়ারের দিকে ঠেলে নিয়ে গিয়ে জোর করে বসিয়ে দিলো। ওখান থেকে লাশটা দেখা যাবে না। তারপর গায়ের শালটা আরো ভালোভাবে তার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে আবার টেবিলটার কাছে। ফিরে গেলো। এলিস আর ওঠার চেষ্টা করলেন না।
ফ্রান্সিস কাগজের গাদা থেকে সবার উপরের কাগজটা তুলে নিয়ে আলোর বিপরীতে ধরলো। লন্ডনের একটা ফার্মের একজন উকিলের চিঠি ওটা। ও জীবনেও নাম শোনেনি আগে। আইনের নানান গালভরা ধারা আর শব্দে ভরা চিঠিটা। ফলে বুঝলো না কিছুই। একটা প্যারার কিছুটা বুঝলো শুধু।
যদি আপনি উনিশে অক্টোবর মাঝরাতের আগে এই ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হন, তাহলে দেওয়ান পাঠিয়ে উল্লেখিত সম্পত্তি আর তাতে অবস্থিত যা কিছু আছে সব দখল করে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
“এখানে আসলে হাই উইল্ড এর কথা বলা হয়েছে,” ফ্রান্সিস বুঝতে পারলো। “আর দিনটাও আজ রাতেই।” ও ঘড়ির দিকে তাকালো। যতোটা ভেবেছিলো, তার চাইতে বেশি রাত এখন। পাহাড়ের উপরের গির্জায় এগারোটার ঘণ্টা বাজানো হয়েছে অনেক আগেই, কিন্তু ও সেটা খেয়াল করেনি। হঠাৎ প্রচণ্ড আতংক গ্রাস করলো ওকে। “ওদের আসতে আর এক ঘণ্টাও নেই।”
ফ্রান্সিস আবার ওর বাবার লাশটার দিকে তাকালো। ভিতরে ভিতরে রেগে গেলো ও, এতোক্ষণের দুঃখিত ভাবটা কেটে যাচ্ছে সেটার কারণে! ওর ঠিক মনে নেই কতোদিন আগে ও টের পেয়েছিলো যে ওর বাবা আসলে একজন জাত জুয়াড়ি। প্রায়ই দেখা যেতো ওদের বাড়ি থেকে রহস্যজনকভাবে রৌপ্যমুদ্রা উধাও হয়ে যাচ্ছে, আবার কয়েক মাস পর দেখা যেতো সেসব আবার ফিরে আসছে। মাঝে মাঝে বসার ঘরে তাসের আসর বসতো। অনেক রাত পর্যন্ত চলতো সেগুলো, ফ্রান্সিসের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিলো না। পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙলেও দেখতে সেগুলো চলছে। ওর বাবার মেজাজও একেক সময় একেক রকম থাকতো। কখনো সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে যেতো চুপচাপ, বেজার হয়ে আবার কখনো খুশিতে ঝলমল করতেন। ফ্রান্সিস আর এলিসের জন্যে গাদা গাদা উপহার নিয়ে আসতেন তখন। প্রায়ই দেখা যেতো অপরিচিত লোকজন আসছে বাড়িতে। সিঁড়ির রেলিং-এর আড়াল থেকে তাদেরকে দেখতে ফ্রান্সিস। কিন্তু ধরা পড়লেই এলিস ওকে টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করে আচ্ছাসে বকতেন।
কিন্তু ও কখনো কল্পনাও করেনি যে অবস্থা এতটা খারাপ। বাইরে থেকে তীব্র একটা শব্দ কাঁপিয়ে দিলো আবার বাড়িটাকে। ফ্রান্সিসের মনে হলো দেওয়ানেরা বোধহয় এসেই পড়েছে। আসলে ওগুলো জানালার কপাট বন্ধ হওয়ার আওয়াজ। ঘড়ির দিকে আর এক নজর তাকিয়ে বুঝলো আর মাত্র পনেরো মিনিট সময় আছে হাতে।