টম সারাহকে দুই হাতে ধরে কপালে চুমু খেলো।
“আমি ভাবছি ফ্রান্সিস এখন কেমন হয়েছে,” কৌতূহলী কণ্ঠে বললো ও।
*
বিশাল বাড়িটা বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে। বাতাস এসে ওটার কিনারে বা গম্বুজে ধাক্কা খেয়ে বিচিত্র শব্দ করছে আর ধুপধাপ করে ঢিলে হয়ে যাওয়া খিড়কিগুলোকে আটকে দিচ্ছে। শুধুমাত্র সবার উপরের তলার শেষ ঘরটা বাদে বাকি সবগুলো জানালা অন্ধকার হয়ে আছে।
ওটা হচ্ছে মাস্টার বেডরুম। একটা মাত্র মোমবাতি মোমদানির উপরে টিমটিম করে জ্বলছে সেখানে। সেই আলোয় ঘরের চারপাশে বিচিত্র সব ছায়া পড়েছে, যেনো ওগুলো সব দৈত্য দানো৷ চিমনি বেয়ে বাতাসের গর্জন শোনা যাচ্ছে। ফায়ারপ্লেসের নিভে যাওয়া কয়লাগুলো তাতে কেঁপে কেঁপে উঠে ঝাঁঝরির উপর নাড়াচাড়া করছে। কয়লা শেষ হয়ে যাওয়ায় কয়েক ঘণ্টা আগেই নিভে গিয়েছে আগুন, কিন্তু তবুও ওটার পাশে দুটো অবয়ব বসে পড়ে নকশা তুলছে, আর একজন কমবয়সী। ছেলে এই মৃদু আলোতেও বই পড়ার ভান করে যাচ্ছে। বিগত পনেরো মিনিট যাবত একটা পৃষ্ঠায়ই আটকে আছে সে।
মহিলাটা হঠাৎ মৃদু আর্তনাদ করে উঠলেন। তার ছেলে দৌড়ে এলো কাছে।
“কি হলো আম্মু?”
মহিলা নিজের আঙুল মুখে পুরে খানিকটা রক্ত চুষে নিলেন। “এই আলোয় চোখে দেখা যায় না, ফ্রান্সিস।”
মহিলা হচ্ছে এলিস লেইটন-আগে নাম ছিলো এলিস গ্রেনভিল, এরপর এলিস কোর্টনী। ছেলের দিকে তাকালেন উনি, ছেলের চেহারায় দুশ্চিন্তার ছোঁয়া দেখে আপ্লুত হয়ে গিয়েছেন। ছেলের বয়স পুরো আঠারো হয়নি, কিন্তু এখনই তাগড়া জোয়ান হয়ে গিয়েছে বলা যায়। তবে ছেলেটার মন বড় নরম। মহিলার চিন্তার কারণ সেটাই। বাইরের শয়তানিতে ভরা দুনিয়াতে ছেলেটা কিভাবে কি করবে কে জানে। খাড়া খাড়া কালো চুল, সেই সাথে বাদামী গায়ের রঙ আর মায়াবী কালো চোখে ছেলেটাকে অনিন্দ্য সুন্দর লাগে। চোখের পাতার ঠিক উপরে কপালেও এক গোছা কালো চুল আছে ওর। মহিলা খেয়াল করে দেখেছেন যে গায়ের মেয়েরা ওর দিকে কিভাবে তাকায়। কোনো একসময়, ঠিক একই দৃষ্টিতে উনিও ওর বাবার দিকে তাকাতেন।
জানালার কপাট দড়াম করে বাড়ি খেলো আবার। যেনো শয়তান নিজে এসে দরজায় করাঘাত করছে। ফ্রান্সিস হাতের বইটা বন্ধ করে একটা লোহার শলা দিয়ে ফায়ারপ্লেসের ভিতর খোঁচাখুঁচি করতে লাগলো। কিন্তু ছাই বাদে আর কিছু বের হলো না।
“বাবা কোথায় গিয়েছে জানো?”
ওর বাবা-মানে আসলে সৎ বাবা। তবে এনাকেই ও বাবা হিসেবে জানে। গত এক সপ্তাহ যাবত বলা যায় লাইব্রেরিতেই নিজেকে বন্দী করে রেখেছেন উনি। কি সব কাগজপত্র নিয়ে পড়ে আছেন, যেসব ওদেরকে দেখতে দিচ্ছেন না। একবার ফ্রান্সিস দেখে করতে গিয়েছিলো, স্যার ওয়াল্টার ওকে বকাঝকা করে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
এলিস হাতের কাপড়টা নামিয়ে রাখলেন। ওনার কালো চুলে বয়সের আগেই পাক ধরেছে, চোখে কোটরের ভিতরে প্রায়, ধূসর চামড়া গালের কাছটায় কুঁচকে গিয়েছে। ফ্রান্সিসের এখনো ওর মায়ের সুন্দর আর হাস্যোজ্জ্বল চেহারাটা মনে আছে। সেই ছোটবেলায় মা যখন কোনো পার্টি বা নাচের অনুষ্ঠান থেকে ফিরতো, তখন ফিরেই আগে ওর ঘরে এসে ওর কপালে চুমু দিয়ে শুভরাত্রি জানাতে। তার চামড়া থেকে তখন আভা বের হতো, চোখ জোড়া ঝলমল করতো। মা যখন ওর দিকে ঝুঁকে আসতো তখন ও মায়ের গায়ের সুগন্ধীর ঘ্রাণ পেতো, তার নরম তুলতুলে হাত ওর গালে স্পর্শ করতো। মায়ের গলার হীরার হারটা মোমের আলোয় ঝিকমিকিয়ে উঠতে। সেই হীরাগুলোই সবার আগে হাতছাড়া হয়েছে।
খালি বাড়িটায় আবার একটা প্রচণ্ড শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ছুটে গেলো। মেঝে শুষ্টু কেঁপে উঠলো তাতে। ফায়ারপ্লেসের কয়লা, সব এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়লো। ফ্রান্সিস লাফ মেরে উঠে দাঁড়ালো।
“বজ্রপাত নাকি?” অনিশ্চিত স্বরে বললেন এলিস।
ফ্রান্সিস মাথা নাড়লো। “জানালাও না। নিচ থেকে এসেছে শব্দটা।”
বলে ও লম্বা বারান্দাটা ধরে হেঁটে গিয়ে বিশাল সিঁড়িটা ধরে নেমে এলো। মোমবাতি থেকে মোম গড়িয়ে পড়ে ওর হাতে ছ্যাকা দিতে লাগলো। কিন্তু হাই উইন্ডে আর কোনো রূপার মোমবাতিদান অবশিষ্ট নেই। ফ্রান্সিস সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে বাতাসে গন্ধ শুকলো। শিকারের অভিজ্ঞতা থেকে ও গান পাউডারের ঘ্রাণ ভালোই চেনে। স্থানীয় সেনাবাহিনির মহড়ার সময়েও দেখেছে। কিন্তু এ বাড়িতে কখনো এই জিনিসের ঘ্রাণ পায়নি।
বুকের ভিতর একটা শঙ্কা দলা পাকিয়ে উঠলো ওর, হৃৎপিণ্ড বাড়ি খেতে লাগলো বুকের খাঁচার সাথে। ও দৌড়ে লাইব্রেরির দরজার কাছে পৌঁছালো। “বাবা?” ডাক দিলো ও। “বাবা ঠিক আছেন আপনি?”
উত্তরে শুধু জানালার কাঁচে বৃষ্টির ফোঁটা পতনের শব্দ বাদে আর কিছুই পাওয়া গেলো না। ও দরজাটা খোলার চেষ্টা করলো কিন্তু সেটা আটকানো। হাঁটু মুড়ে বসে ও চাবির ফুটো দিয়ে ভিতরে তাকালো। কিন্তু ফুটোয় চাবি ভরা থাকায় ওপাশের কিছুই দেখা গেলো না।
“বাবা?” আরো একবার চেষ্টা করলো ও। এবার আগের চাইতে জোরে। গত দুই সপ্তাহ ধরে ওর বাবা প্রায় কোনো বিরতি ছাড়াই মদ খেয়ে যাচ্ছে। হয়তো উনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন।
মোমবাতিটা নামিয়ে রেখে ও পকেটা হাত ঢুকিয়ে একটা ছুরি বের করে আনলো। তারপর আস্তে সেটাকে চাবির ফুটোয় ঢুকিয়ে ধাক্কা দিতে দিতে ওপাশের মেঝেতে চাবিটা ফেলে দিলো। পুরনো দরজাটার নিচে প্রায় এক ইঞ্চি মতো ফাঁকা আছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে ও ঘরের শেষ মাথায় টুপি ঝোলানোর জায়গাটায় একটা খড়ের টুপি দেখতে পেলো। টুপিটা নিয়ে এসে সেটার সাহায্যে দরজার নিচ থেকে চাবিটা টেনে নিয়ে এলো।