অ্যানা নিজের মাথা নাড়লো।
“এগুলো আমার মালপত্র।”
“আপনার?”
“আমিই কর্তৃপক্ষ।”
“আপনি?” টম ওর আশ্চর্য ভাবটা লুকানোর কোনো চেষ্টাই করলো না।
সারাহ কনুই দিয়ে ওকে গুতো দিলো। “টম কোর্টনী। তুমি একটা আস্ত গবেট। তুমি পুরো আফ্রিকা জুড়ে মহিলা সেনানায়ক, মহিলা ডাকাত, মহিলা মানুষখেকোদের দেখেছো আর জিনিসপত্র বিক্রি করেছো আর এখন কিনা মহিলা ব্যবসায়ী দেখেই তব্দা খেয়ে গেলে?”
অ্যানা আর সারাহ দৃষ্টি বিনিময় করলো-ওদের চোখাচোখির কিছুই বুঝলো না টম। তবে নিজেকে আসলেই বেকুব আর বুদ্ধ মনে হতে লাগলো ওর। এদিকে সারাহের মুখে ওর নাম শুনে ইঞ্চবার্ডের মুখভঙ্গির আশ্চর্য পরিবর্তন ওর চোখে পড়লো না।
সারাহ ওর হাতের ভিতর নিজের বাহু ঢুকিয়ে একদিকে টেনে নিয়ে গেলো। “চলোতো, মিষ্টি করে বললো ও। “মিস দুয়ার্তের উপর যথেষ্ট ধকল গিয়েছে, এখন এভাবে ওনাকে হা করে গিলতে হবে না। চলো কয়টা কাপড়ের গাটরি পছন্দ করি, যা দিয়ে আমাদের বন্দুকের গুলি আর পাউডারের দাম উঠে যাবে। তারপর এদেরকে শান্তিমতো নিজেদের পথে চলে যেতে দেই।”
*
সেদিন পুরোটা, এরপর আরো গোটা একটা দিন লেগে গেলো ওদের আলাদা হতে। সারাহ আর ইয়াসমিনি আহতদের সেবা করলো। টম, ডোরিয়ান আর আবোলি ইঞ্চবার্ডের লোকদেরকে জাহাজ মেরামতে সাহায্য করলো। ওরা মিলে আবার একটা মাস্তুল খাড়া করে দিলো। জাহাজের প্রায় অর্ধেক ক্রু মারা পড়েছে, ফলে সেন্টারাসের লোকেরা রশি পাকিয়ে আর মাস্তুলে চটা মেরে আবার খাড়া না করে দিলে আবার জাহাজটার পক্ষে একা চলা সম্ভব হতো না।
“আবহাওয়া ঠিক থাকলে এটা দিয়েই কেপ টাউনে পৌঁছে যাবো,” ইঞ্চবার্ড বললো। “ওখান থেকে নতুন লোক ভাড়া করে লন্ডনের দিকে যাত্রা করবো।”
কাজটা খুব একটা সহজ না। কিন্তু টম টের পেলো যে ইঞ্চবার্ড চাচ্ছে ওরা জাহাজ থেকে চলে যাক। ব্যপারটা ওর কাছে ভালোই লাগলো। ওরাও তাই দেরি না করে বিদায় নিয়ে ফিরে চললো।
বাতাস পরিষ্কার। রাত নামতেই সারাহ আর টম জাহাজের পিছনের গলইতে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত অবলোকন করলো। সূর্যটা পশ্চিম আফ্রিকার অনাবিষ্কৃত দেশগুলোর ওপাশে টুপ করে ডুবে গেলো।
“তুমি ঐ দুয়ার্তে মেয়েটার কথা ভাবছো, তাই না?” সারাহ বললো।
“আরে না, না,” টম বলতে গেলো কিন্তু ওকে থামিয়ে দিলো সারাহ।
“আমাদের যদি একটা ছেলে থাকতো তাহলে ঠিক ওর মতোই একটা বৌ চাইতাম আমি।”
টম সারাহকে আরো কাছে টেনে নিলো। বিয়ের পর থেকেই ওরা বাচ্চা নেওয়ার জন্যে অনেক চেষ্টা করেছে। কয়েক বছর আগে সারাহ গর্ভবতীও হয়েছিলো, তখন ওরা লুঙ্গা নদীতে ব্যবসা করে বেড়াচ্ছিলো; টম ভেবেছিলো ওদের জীবন এবার পূর্ণতা পাবে। কিন্তু সারাহের গর্ভপাত হয়ে যায়, আর তার পর থেকেই ওদের শত চেষ্টার পরেও আর সারাহের গর্ভ সঞ্চার সম্ভব হয়নি।
“তোমার কি কখনো মনে হয়েছে যে তুমি ইংল্যান্ডে থেকে গেলেই ভালো করতে?” সারাহ জানতে চাইলো। “ডেভনের (একটা শহর) কোনো সুন্দরি মেয়েকে বিয়ে করে হাই উইল্ড-এ (টমদের বাড়ির নাম) বাড়ি বানিয়ে থাকলেই ভালো হতো। ডজনখানেক বাচ্চাকাচ্চা হতো।”
টম সারাহের গালে আলতো একটা চাপড় দিলো। “কখনোই না। আর হাই উইল্ড এর মালিক হচ্ছে ব্ল্যাক বিলি।” টমদের বংশের নিয়ম অনুযায়ী সব সম্পত্তির মালিক হয় বড় ছেলে। বিলি ডেভনের সবচেয়ে বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করেছিলো। তবুও সম্পত্তির লোভে বিলি ওদের বাবাকে সময়ের আগেই কবরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলো। কিন্তু সেই সম্পত্তি ভোগ করার জন্যে বেঁচে থাকতে পারে নি সে।
“সম্পত্তির মালিক এখন হবে বিলির ছেলে ফ্রান্সিস।” টম বলে থামলো একটু। মায়ের কোলে শোয়া একটা লালমুখো ছেলের কথা মনে করার চেষ্টা করছে। “এতদিনে তাগড়া জোয়ান হয়ে যাওয়ার কথা ওর। হাই উইল্ডের জমিদার-ও হয়ে গিয়েছে।”
সারাহ বাতাসের তোড়ে উড়তে থাকা কাপড় সোজা করলো আবার। “সময় আমাদের সবার সাথেই বড় নির্দয় আচরণ করে, টম কোর্টনী।”
টম দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রইলো, সূর্যের শেষ কিরণটা সেখানে সমুদ্রকে লেহন করছে। ঢেউ এসে সেন্টারাসের খোলে বাড়ি খেয়ে গর্জন করছে, জাহাজটা এখন যাচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিমে, আফ্রিকার সর্ব দক্ষিণে কেপ টাউনে। হাই উইল্ড থেকে পালিয়ে আসার পর এই শহরটাকেই টম বাড়ি হিসেবে পরিচয় দেয় এখন। কেপ টাউনে ওরা জাহাজটার টুকটাক মেরামত করবে, কিনে আনা মালপত্র বিক্রি করবে, নতুন মালামাল কিনবে, তারপর কয়েক মাস পর আবার হয়তো নতুন কোনো অভিযানে বের হবে।
টম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। জীবনে কোনো কিছু নিয়ে ওর দুঃখ নেই, কিন্তু বড় হওয়ার পথে ওকে কতোটা কষ্ট করতে হয়েছে সেসব ও ভুলে যায়নি। সেই বিশাল পুরনো বাড়িটা, সেই গির্জাটা যেটার প্রাঙ্গণে অসংখ্য কোর্টনী কবরে শুয়ে আছে। ওর দাদার সেবা করা চাকরেরা, যাদের সন্তানেরা অনাগত কোর্টনীদের সন্তানদের সেবা করবে, সবই ছিলো একটা বিশাল কিছুর অংশ হিসেবে থাকার অনুভূতি। এখন ও যেখানেই থাকুক না কেননা, ওর শিকড় ওখানেই প্রোথিত, অনেক গভীরে। ও নিজেকে ওখান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে, কিন্তু এখনো নতুন কোনো জমিনের সন্ধান পায়নি যেখানে নতুন করে শিকড় গাড়তে পারে।