বাতাসে ধোয়া কেটে গিয়েছে ততক্ষণে। লেগ্রাঞ্জের পিছনে তাকিয়ে টম দেখলো যে জাহাজ দুটো সরে যাচ্ছে দূরে। ডোরিয়ান ডাওজারকে মুক্ত করে ফেলেছে। ওকে এখনি সাঁতরে ওটায় গিয়ে উঠতে হবে-কিন্তু সামনেই দাঁড়িয়ে আছে লেগ্রাঞ্জ, গদার মতো করে ধরে আছে নিজের মাস্কেটটা। টম পিছিয়ে গিয়ে মাথা নিচু করে দস্যুর ভয়ানক বাড়িগুলো এড়িয়ে যেতে লাগলো। ততোক্ষণে পূর্ণোদ্যমে জ্বলতে শুরু করেছে আগুন; আর সবাই আগুন নেভানোয় ক্ষান্ত দিয়ে নিজের জান বাঁচানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু লেগ্রাঞ্জ। তবুও টমকে আক্রমণ করতেই থাকলো, এতো দ্রুত ও হাতের অস্ত্রটা ঘোরাতে লাগলো যে টম যে কিছু একটা হাতে তুলে নেবে সে সুযোগই পাচ্ছিলো না।
টম আর এক ধাপ পিছিয়ে গেলো আর একটু পরেই জাহাজের কিনার। বহু কষ্টে মাস্কেটের আরো একটা আঘাত এড়িয়ে ও রেইলের উপর শরীরটা টেনে তুললো।
সরু ধারটার উপর ভারসাম্য রক্ষা করতে করতে ও নিচের পানির দিকে তাকালো একবার। জাহাজটা বাতাসের ধাক্কায় আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। ও যদি লাফ দেয় তাহলে বাতাস ওকে জাহাজের নিচে ঠেলে দেবে। সেক্ষেত্রে জাহাজের খোলে লেগে থাকা শামুকে কেটে মোরব্বা হতে সময় লাগবে না। তবে যদি এর আগেই হাঙ্গর ওকে ধরে ফেলে তাহলে ভিন্ন কথা।
লেগ্রাঞ্জও ব্যাপারটা জানে। ও তাই আক্রমণে কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে ব্যাপারটা উপভোগ করলো। ও জানে না যে টম কে, কোথা থেকে এসেছে বা কিভাবে জাহাজে উঠেছে, শুধু জানে যে টম ওর হাত থেকে ওর শিকার কেড়ে নিয়েছে। আর টমের জন্যেই ওর জাহাজটাও এখন হারাতে হচ্ছে। আবারও একটা ক্রুদ্ধ গর্জন ছেড়ে ও টমের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। উদ্দেশ্য টমকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেবে।
টম আঘাতটাকে এড়িয়ে পিছন দিকে ঝাঁপ দিলো। অবাক চোখে লেগ্রাঞ্জ দেখলো, টম নিচের পানিতে আছড়ে না পড়ে শূন্যে ভাসছে। তারপর জাহাজের পাশ থেকে এমনভাবে উড়ে গেলো যেনো ওর পাখা গজিয়েছে।
লেগ্রাঞ্জ খেয়াল করেনি যে জাহাজের মাস্তুলের আড়কাঠের সাথে পাল খাটানোর যে দড়িটা বাধা সেটা টম আগেই ধরে ফেলেছিলো। টম ঝুলতে ঝুলিতে যতোদূর সম্ভব দূরে গিয়ে আবার ফিরে আসতে লাগলো, আসার সময় গতি আরো বেশি বেড়ে গেলো কারণ জাহাজ ঘুরে গিয়ে ওর ভরবেগ আরো বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। ও পা দুটো ভাজ করে বুকের কাছে তুলে আনলো, তারপর লেগ্রাঞ্জের কাছে আসতেই সপাটে পা চালালো। বুটশুদ্ধ পা জোড়া লেগ্রাঞ্জের কপালে আঘাত হানলো। এতো জোরে লেগ্রাঞ্জের শরীরটা বেঁকে গেলো যে টম স্পষ্ট ওর মেরুদণ্ড ভাঙার শব্দ শুনতে পেলো। লেগ্রাঞ্জ পা ভাঁজ হয়ে পিছনে উল্টে পড়ে গেলো। সাথে সাথে আগুন এসে গ্রাস করালো ওকে। এক মুহূর্তের জন্যে টম লেগ্রাঞ্জের ভয়ার্ত মুখটা দেখতে পেলো। ওর দাড়ি, চুল আর কাপড়ে আগুন ধরে গিয়েছে ততোক্ষণে, চেহারায় ফোস্কা পড়ে কাঁপছে।
টম দড়িটাতে ঝুলে উল্টো পাশের পানির উপর পৌঁছে গেলো। তারপর বিপরীত দিকে ফিরতে শুরু করতেই ছেড়ে দিলো দড়িটা। ঝুপ করে পড়লো গিয়ে পানিতে। হাঙ্গরেরা ওর রক্তের গন্ধ পাওয়ার আগেই শক্ত হাতে সাঁতার কেটে সহজেই ডাওজারের কাছে পৌঁছে গেলো ও। ডোরিয়ান মইয়ের শেষ ধাপে অপেক্ষা করছিলো ওকে ধরে টেনে তোলার জন্যে।
“সারাহ আর ইয়াসমিনি কোথায়?” হাফাতে হাফাতে বললো টম। তখনো শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়নি। ও পাগলের মতো ডাওাজারের চারপাশের পানিতে খুঁজতে লাগলো, তারপর ফাইটিং কক-এর জ্বলন্ত শরীরের ফাঁক দিয়ে ওদের দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
টম এরপর নিজের মনোযোগ ফেরালো দস্যুদের জাহাজের প্রতি। অগ্নিকুণ্ড ওটার প্রতিটা মাস্তুল আর কিনার ধরে জ্বলছে, পালগুলোতেও একই অবস্থা। কয়েকজনের গায়েও লেগে গিয়েছে আগুন। লোকজন থাকতে না পেরে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। যেসব দস্যু ডাওজারে আটকা পড়েছে তারা যে খুব আরামে আছে তা কিন্তু না। জাহাজের ক্রুরা সবাই ভয়ানক হিংস্র হয়ে আছে। কাউকেই ছাড়া হচ্ছে না। ঠিক দস্যুরা যেরকম বলেছিলো।
“একটা নৌকা নামিয়ে দেওয়া উচিত, সমুদ্রে হাবুডুবুর দস্যুদের দেখিয়ে বললো ডোরিয়ান। হাঙরের ডানা দেখা যেতেই চিৎকার শুরু হয়ে গেলো সবার মাঝে।
“এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে লাভ কি বলো, কেপ টাউনে গিয়ে সেই ফাঁসিতেই ঝুলতে হবে,” টম মনে করিয়ে দিলো।
ঠিক সেই মুহূর্তে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের ধাক্কায় ওদের ফুসফুসের সব বাতাস বেরিয়ে গেলো, হল্কা এসে লাগলো সবার গায়ে। একটা বিশাল ঢেউ এসে জাহাজকে নাড়িয়ে দিয়ে গেলো। যারা দাঁড়িয়ে ছিলো সবাই-ই ডেক-এ ছিটকে পড়লো। জ্বলন্ত ছাই আর ধ্বংসাবশেষ ঝরতে লাগলো উপর থেকে। সামনে তাকিয়ে দেখা গেলো ফাইটিং কক বেমালুম গায়েব হয়ে গিয়েছে। শুধু কিছু পোড়া কাঠ ভাসতে দেখা যাচ্ছে পানিতে।
টম কষ্টে সৃষ্টে উঠে দাঁড়ালো। এখন আর কাউকে উদ্ধারের চিন্তা করে লাভ নেই। পানিতে থাকা প্রত্যেকটা লোকই নিশ্চিত অজ্ঞান হয়ে বিস্ফোরণের ধাক্কায় তলিয়ে গিয়েছে।
“ওটার পাউডার ম্যাগাজিনে লেগেছিলো মনে হয়।” জাহাজের পাশ থেকে এক পোড়খাওয়া চেহারার লোক বলে উঠলো। গায়ের কোট হারিয়ে ফেলেছে। সে; আর তার বাহু আর গালের একটা কাটা থেকে রক্ত ঝরছে। এরপরেও তার চেহারায় কর্তৃত্বের ছাপটা স্পষ্ট দেখতে পেলো টম।