“হুইল ধরো” বুড়ো মাঝিকে হুইল ধরিয়ে দিয়ে ছোট্ট চার্ট টেবিলে ছেলের পাশে গিয়ে বসলেন লোথার। “আজ গণিত নয়; ইংরেজি পড়ব।”
“আমার ইংরেজি একটুও ভালো লাগে না!” বিতৃষ্ণা নিয়ে ঘোষণা করল ম্যানফ্রেড, “ইংরেজি আর ইংরেজ দু’টোকেই ঘৃণা করি।”
মাথা নাড়লেন লোথার। “হ্যা” একমত হয়ে বললেন, “ইংরেজরা আমাদের শত্রু। সবসময় তাই ছিল আর ভবিষ্যতেও থাকবে। আর এই কারণেই তাদের অস্ত্র দিয়ে নিজেদেরকে বলীয়ান করতে হবে। এ কারণেই ভাষাটা শিখতে হবে, যখন সময় আসবে তখন যেন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এর সদ্ব্যবহার করা যায়।”
সারা দিনের মাঝে এই প্রথমবার ইংরেজিতে কথা বললেন লোথার। ম্যানফ্রেড আফ্রিকান ভাষায় উত্তর দিতে গেলেও হাত তুলে থামালেন লোথার।
“ইংরেজি।” তিরস্কারের সুরে ছেলেকে বললেন, “শুধু ইংরেজি বলো।”
পরবর্তী চার ঘণ্টায় পিতা-পুত্র মিলে শেষ করল বাইবেলের কিং জেমস অংশ আর কেপ টাইমস পত্রিকার দু’মাসের পুরনো একটা কপি। এরপর এক পাতা শ্রুতিলিপি লিখতে দিলেন লোথার। অপরিচিত এই ভাষা নিয়ে খাটতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে পড়ল অস্থির ম্যানফ্রেড। শেষপর্যন্ত অধৈর্য হয়ে বলে উঠল,
“আমাকে দাদা আর শপথ সম্পর্কে বলো পা!” আহ্লাদী সুরে বাবার কাছে জানতে চাইল ছেলেটা।
হেসে ফেললেন লোথার, “দিনে দিনে তুই একটা বান্দর হচ্ছিস, তাই না? মাথায় শুধু কাজ ফাঁকি দেয়ার চিন্তা।”
“প্লিজ, পা”
“এ গল্প তো আগেও করেছি।”
“আবার বলো! আজ তো একটা বিশেষ দিন।”
হুইল হাউজের জানালা দিয়ে বহু মূল্যবান রুপালি কার্গোর দিকে তাকালেন লোথার। ছেলেটা ঠিকই বলেছে। আজ সত্যিই একটা বিশেষ দিন। গত পাঁচ বছর ধরে কঠোর পরিশ্রমের পর ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি মিলবে অবশেষে।
“ঠিক আছে” মাথা নেড়ে বললেন, “আবারো বলব ঠিকই, কিন্তু ইংরেজিতে।” ঠাস করে এক্সারসাইজ কপি বন্ধ করে টেবিলের ওপাশ থেকে ঝুঁকে এল ম্যানফ্রেড। আগ্রহে চকচক করছে স্বচ্ছ হলুদাভ বাদামি দু’খানা চোখ।
“তো শোন” শুরু করলেন লোথার, “বিশ্বাসঘাতক ইংরেজ রাজা পঞ্চম জর্জ যখন ১৯১৪ সালে জার্মানির কাইজার উইলহেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল তখন তোমার দাদু আর আমি নিজেদের দায়িত্ব ঠিকই বুঝতে পারলাম। তারপর তোমার দাদিমাকে চুমু খেয়ে বিদায় জানিয়ে-”।
“দাদিমার চুলের রঙ কী ছিল?” জানতে চাইল ম্যানফ্রেড।
“তোমার দাদিমা ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী একজন অভিজাত জার্মান নারী আর সূর্যের আলোয় তার চুল দেখাত ঠিক পাকা গমেরই মতন।
“ঠিক আমার মতন।” বাবাকে শুধরে দিল ম্যানফ্রেড।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তোমার মতন” হেসে ফেললেন লোথার। “তারপর তোমার দাদু আর আমি মিলে ঘোড়ায় চেপে বসলাম অরেঞ্জ নদী তীরের উদ্দেশে; যেখানে বুড়ো জেনারেল মারিটজ আর তার ছয়শ’ বীরের সাথে যোগ দিয়ে ছুটলাম বিশ্বাসঘাতক জ্যানি মুটের খবর নেয়ার জন্য।”
“বলো পা, তাড়াতাড়ি বলো।” তাগাদা দিল ম্যানফ্রেড।
এরপর কামানের গোলা আর মেশিনগানের গুলিতে বিদ্রোহীদেরকে ঝাঁঝরা করে দেয় জ্যানি স্মুটের বাহিনি। লোথারের মুখে প্রথম যুদ্ধের সেই কাহিনি শুনে বেদনার মেঘ এসে ভর করল ম্যানফ্রেডের জোড়া চোখে।
“কিন্তু তোমরাও খুব লড়েছিলে তাইনা, পা?”
“পাগলের মত যুদ্ধ করেছি। কিন্তু ওরা সংখ্যায় বেশি ছিল আর ওদের কাছে বড় বড় কামান, মেশিনগান এসবও ছিল। তারপর তোমার দাদু পাকস্থলীতে গুলি খাওয়ার সাথে সাথে আমার ঘোড়ায় চড়িয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উনাকে সরিয়ে নিয়ে গেছি।” সে কথা শুনে কান্নায় চকচক করে উঠল ছেলেটার চোখ।
“তারপর যখন মৃত্যু কাছে চলে এল, তোমার দাদু বালিশ হিসেবে ব্যবহার করা চামড়ার ব্যাগ থেকে পুরনো কালো বাইবেলটা বের করে আমাকে দিয়ে শপথ করালেন।”
“আমি জানি এই শপথ।” বাবাকে বাধা দিল ম্যানফ্রেড। “দাঁড়াও বলছি।”
“হুম, বলো তো দেখি?” লোথারও মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
“দাদু বলেছে : “এই বইয়ের উপর হাত রেখে আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করো মাই সান, প্রতিজ্ঞা করো যে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ কখনো শেষ হবে না।”
“হ্যাঁ।” মাথা নেড়ে লোথার জানালেন, “ঠিক তাই। মৃত্যুশয্যায় বাবার কাছে আমি এই শপথ করেছি।” হাত বাড়িয়ে ছেলেকে ধরলেন।
পিতা-পুত্রের আবেগঘন এই মুহূর্তে হানা দিল বুড়ো দা সিলভা। কাশি দিয়ে গলা বাড়িয়ে হুইল হাউজের জানালা দিয়ে বাইরে থুথু ফেলল।
“তোমার লজ্জা হওয়া উচিত ছেলেটার মাথায় মৃত্যু আর ঘৃণার কথা ঢোকাচ্ছো।” দা সিলভার কথা শুনেই ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন লোথার।
“তোমার মুখ বন্ধ করো বুড়ো” সিলভাকে শাসালেন। এতে তোমার নাক না গলালেও চলবে।”
“কুমারী মারীয়াকে ধন্যবাদ যে এসব শয়তানেরই কাজ।” বিড়বিড় করে নিজের অসন্তুষ্টি জানাল দা সিলভা।
ঘোঁত ঘোঁত করে সরে এলেন লোথার। “ম্যানফ্রেড, আজকের মত যথেষ্ট হয়েছে। বই রেখে এসো।”
হনহন করে হুইল হাউজ থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে এলেন লোথার। পানি ঠেকানোর জন্য জাহাজের ডেকের উঁচু প্রান্তদেশে আরাম করে হেলান দিয়ে বসে পকেট থেকে লম্বা কালো চুরুট বের করে মাথার খানিকটা কামড়ে থু করে ফেলে দিলেন। এমন সময় মাথা উঁচু করে উঁকি দিল ম্যানফ্রেড; যখন দেখল বাবা কিছু বলেনি, লাজুক ভঙ্গিতে উঠে এসে বাবার পাশে বসল।