একঘেয়ে কাজটা অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য আর প্রতিবার মাথার ওপর জাল উঠলেই সমুদ্রের ঠাণ্ডা জলে ভিজে নেয়ে উঠছে নাবিকের দল। তাই মাঝে মাঝেই ক্রুদের স্থান পরিবর্তন করাচ্ছেন নৌকার ক্যাপ্টেনগণ। যদিও লোথার নিজে এখনো কপিকল থেকে এক চুলও নড়েননি। লম্বা, ক্লান্তিহীন আর সদা সতর্ক লোথারের সাদা সোনালি চুলে আটকে গেছে মাছের আঁশ; সূর্যের আলোয় ঠিক আগুনের মতই চকচক করছে।
“সিলভার থ্রি পেনিস।” নিজের চারটি ট্রলারের হোল্ড ভর্তি মৎসবৃষ্টি দেখে আপন মনেই হাসলেন। “আজ ডেক ভর্তি টিকি (Tickey) নিয়ে যাবো।” টিকি হল নাবিকদের মাঝে প্রচলিত থ্রি পেনির পরিবর্তিত স্ল্যাং।
“ডেকলোড।” খালি হয়ে আসা মেইন জালের কাছে কপিকল নিয়ে ব্যস্ত সোয়ার্ট হেনড্রিকের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠলেন লোথার। পালিশ করা আবলুস কাঠের মতই চকচক করছে সোয়াটের কোমর পর্যন্ত উদোম শরীর।
“ডেকলোড!” পাল্টা চিৎকার করে নিজ আনন্দ প্রকাশ করলেন সোয়ার্ট। প্রতিটি ট্রলারের হোন্ডে দেড়শ’ টন করে মাছ তোলা হয়েছে। এখন তারা ডেকলোড করবেন।
আবারো একটা বড় ঝুঁকি নিতে চলেছেন লোথার, একবার লোড করা হয়ে গেলে বন্দরে ফিরে ফ্যাক্টরিতে মাছ পাম্প করে বের না করা পর্যন্ত নৌকা আর খালি হবার উপায় নেই। কিন্তু ডেকলোডিং করা হলে আরো একশ’ টন ওজনের মাছ ভোলা হবে। যা নিরাপদে বহনযোগ্য ওজনের সীমা ছাড়িয়ে যাবে। আর যদি এর ভেতরে আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়, তাহলে এক ধাক্কায় অতিরিক্ত ভার বহনকারী ট্রলারকে শীতল সবুজ গহীনে নিয়ে যাবে সমুদ্রের দৈত্য।
“আবহাওয়া নিশ্চয় এরকমই ভালো থাকবে।” কপিকল নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে নিজেকেই যেন আশ্বস্ত করলেন লোথার। অসম্ভব ভয়ংকর এক ঝুঁকি নিয়ে এক হাজার টন মাছ তুলেছেন। একবার জাল ছুঁড়েই পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড লাভ। জীবনে এতটা সৌভাগ্যের দেখা কখনো পাননি। জাল-নৌকা কিংবা নিজের জীবনও হারাতে পারতেন, কিন্তু না; এবারে সব দেনা শোধ করতে পারবেন।
“ঈশ্বরের দিব্যি, এখন আমার সাথে আর খারাপ কিছু ঘটবে না। এবারে পুরো মুক্ত হয়ে যাবো।”
চারটি ট্রলারের উপরেই চক্কর কাটছে সাদা মেঘের মত একঝাক সী বার্ডস। পার্স লাইন দিয়ে জালের ভেতর ঢুকে রাক্ষসের মত মাছ খেতে শুরু করল পাখির দল। শেষে এমন অবস্থা যে উড়ে যাবারও সাধ্য নেই। ফোলা পেট নিয়ে কোনোমতে স্রোতের তোড়ে ভেসে গেল। অন্যদিকে হাতে ধারালো লোথার আংটাযুক্ত দণ্ড নিয়ে প্রতিটি ট্রলারের বো আর স্টার্নে দাঁড়িয়ে আছে একজন করে নাবিক। কারণ একটু পরপর আঘাত করে বড় বড় সব হাঙর তাড়াতে হচ্ছে। জালে আটকা পড়া মাছের ঝাক খাবার নেশায় আগত হাঙরগুলোর ত্রি-কোণাকার ছুরির মত তীক্ষ্ণ লম্বা দাঁতগুলো শক্ত জালও কেটে ফেলতে ওস্তাদ।
অন্যদিকে মাছের ভারে আস্তে আস্তে পানিতে ডুবে যাচ্ছে প্রতিটি ট্রলারের শরীর। অবশেষে দুপুরের একটু পরে লোথার নিজেই থামার নির্দেশ দিতে বাধ্য হলেন। আর একটা মাছও তোলার জায়গা নেই। বরঞ্চ নৌকার পাশ দিয়ে পড়ে হাঙরের পেটে যাচ্ছে।
কপিকলের সুইচ বন্ধ করে দিলেন লোথার। মেইন জালে এখনো না হলেও আরো একশ’ টন মাছ ঝুলছে। “জাল খালি করে ফেলল।” আদেশ দিলেন লোথার। “মাছ ফেলে জাল নৌকায় তুলে আনো।”
অতিরিক্ত ভারে পানিতে প্রায় ডুবুডুবু হয়ে এক সারিতে বাড়ির পথ ধরল চারটা ট্রলার। সবার আগে পথ দেখাচ্ছে লোখারের নৌকা।
পেছনে প্রায় এক মাইল পর্যন্ত সমুদ্রে কার্পেটের মত বিছিয়ে রইল মরা মাছ। রুপালি পেট উপরে দিয়ে এমনভাবে ভাসছে যেন অরণ্যের মেঝেতে ছড়িয়ে আছে বসন্তের ঝরা পাতা। ঠিক তার উপরেই হাজার হাজার পরিতৃপ্ত সি-গাল আর মহা ভোজে ব্যস্ত বড় বড় হাঙর।
পরিশ্রমে নিঃশেষিত নাবিকের দল ডেকের ওপর এখনো তড়পাতে থাকা মাছের ঝাঁকের ওপর দিয়ে কোনোমতে নিজেদেরকে টানতে টানতে নিচের ডেকে নিয়ে গেল। মাছের আঁশ আর সমুদ্রের জলে স্নাত শরীর নিয়েই ছোট্ট বাঙ্কের ওপর গড়িয়ে পড়ল সবাই।
অন্যদিকে হুইল হাউজে পরপর দু’মগ গরম কফি খেয়ে মাথার উপরের ক্রনোমিটার চেক করলেন লোথার।
“ফ্যাক্টরিতে ফিরতে আরো চার ঘন্টা লাগবে। আমাদের পড়ার সময় হয়েছে এখন।”
“ওহ, পা!” আকুতি জানাল ছেলেটা, “আজ নয়। আজ একটা বিশেষ দিন। না পড়লে হয় না?”
ওয়ালবিস বে’তে কোনো বিদ্যালয় নেই। সবচেয়ে কাছের সোয়াকোপমুণ্ডের জার্মান স্কুলটাও ত্রিশ কি.মি. দূরে। জন্মের পর থেকে লোথারই ছেলেটার বাবা আর মা। রক্ত আর জলে ভেজা ছোট্ট শরীরটার দিকে মা তাকিয়ে দেখেনি। নার্সের দুধ ব্যতীত একা হাতেই ছেলেটাকে লালন-পালন করেছেন লোথার। তাই দুজনের আত্মিক বন্ধন এতটাই বেশি যে, একদিনের জন্য ওকে ছাড়া থাকতে পারবেন না। দূরে না পাঠিয়ে শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থাও তাই তাকেই করতে হয়েছে।
“কোনোদিনই এতটা বিশেষ নয়।” ম্যানফ্রেডকে বললেন “প্রতিটি দিনই আমাদেরকে কিছু না কিছু শিখতে হবে। কেবলমাত্র পেশি থাকলেই কেউ শক্তিশালী হয় না। নিজের মাথায় টোকা দিয়ে বললেন, “এটাই একজন মানুষকে শক্তিশালী করে তোলে। যাও, বই নিয়ে এসো!”
সাহায্যের আশায় দা সিলভার দিকে চোখ গোল গোল করে তাকাল ম্যানফ্রেড, কিন্তু জানে তর্ক করে লাভ নেই।