ঝুঁকিটা তাই একটু বেশিই হয়ে যাবে। চোখের কোনা দিয়ে দা সিলভার বিক্ষুব্ধ ইশারা দেখল, আর এবার তো উদ্বেগে হুইসেল দিয়ে ফেলল। এত মাছ দেখে ভড়কে গেছে বুড়োটা। হেসে ফেললেন লোথার। হলুদ চোখ দুটোকে সরু করে ম্যানফ্রেডকে জাল ছোঁড়ার স্পিড দিতে ইশারা করেই, ইচ্ছে করে বুড়োর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন লোথার।
গতি পাঁচ নটে উঠতেই ম্যানফ্রেডকে দিয়ে সজোরে নৌকাটা ঘুরিয়ে আনলেন। ঝাঁকের মাছগুলোকে চক্রের মধ্যেই থাকতে বাধ্য করলেন। তারপর দ্বিতীয়বার চক্কর দেয়ার সময় ট্রলারের স্টার্নের কাছে গিয়ে হাত গোল করে মুখের উপর রেখে চিৎকার করে বললেন, “লুস! জাল ছুঁড়ে মারো!”
স্টার্নে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণাঙ্গ হেরেরো নাবিক ডিঙ্গির দড়ি আটকে রাখা পিচ্ছিল গিঁটের গায়ে কয়েকবার আঘাত করেই নৌকার কিনার দিয়ে ছুঁড়ে মারল। ছোট্ট কাঠের ডিঙ্গি ক্যাচকোচ করে সশব্দে পেছন দিকে আছড়ে পড়ে স্রোতের ফেনায় আগু-পিছু দুলতে লাগল। সাথে করে টেনে নিয়ে গেল ভারি বাদামি রঙা জাল।
ঝাঁকের চারপাশে ঘুরছে ট্রলার। আর কাঠের রেইলের উপর দিয়ে ঘষা খেয়ে হিসহিস শব্দে পানিতে নেমে যাচ্ছে মোটা ফাঁকলা জাল। পাইথনের মতই কুপুলি খুলে তরতর করে নেমে যাচ্ছে কর্ক লাইন, যা কিনা ডিঙ্গি আর ট্রলারকে মায়ের গর্ভে থাকা প্রাণের নালীর মত জুড়ে রেখেছে। পুরো ঝাকটার চারপাশে সমানভাবে বিছিয়ে গেছে জাল। এখন কেবল দা সিলভা আর তার ডিঙ্গি নিয়ে যত চিন্তা।
বিশাল জালটার ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য হুইল নিয়ে কাজ করছে ম্যানফ্রেড। একটু পরে থ্রটল বন্ধ করে দিল। কাঁধে তিন ইঞ্চি ভারি ম্যানিলা লাইনের শেষপ্রান্ত নিয়ে ট্রলারের সাইড বেয়ে উপরে উঠে এল দা সিলভা।
লোথারকে দেখেই গর্জন করে জানাল, “জালটাকে হারাবে, আর কিছু না। কেবল কোনো পাগলই পারে এমন মাছের ভেতর জাল ফেলতে। সাধু আন্তনী আর সাধু মার্কের সাক্ষী মেনে বলছি, হতচ্ছাড়াগুলো জাল নিয়ে ভাগবে, দেখো।” কিন্তু লোথারের নির্দেশ পেয়ে ততক্ষণে জাল উপরে তোলার কাজ শুরু করে দিয়েছে হেরেরো নাবিকের দল।
“জালও আমার আর মাছও আমার।” বিকট শব্দে কপিকল চালু করে দিলেন লোথার, “বুকি হুকে লাগাও!”
পরিষ্কার সবুজাভ পানির সত্তর ফুট গভীরে ঝুলে আছে জাল। কিন্তু তলদেশ এখনো ভোলা। তাই সবচেয়ে প্রথম আর জরুরি কাজটা হল মাছের ঝাঁক পালাবার পথ পাবার আগেই জালটাকে বন্ধ করে ফেলতে হবে। কপিকল ঘুরিয়ে একের পর এক পার্স লাইন টেনে আনতে গিয়ে কঠোর পরিশ্রমে ফুলে উঠেছে লোথারের নগ্ন বাহুর পেশি আর প্রতিটি গিট। জালের তলদেশের স্টিল রিংয়ের ভেতরে থাকা পার্স লাইন আস্তে আস্তে মুখটাকে বন্ধ করে ফেলছে। ঠিক যেন চোয়াল দুটো এক করে ফেলছে কোনো দানবের মুখ।
অন্যদিকে হুইল হাউজে খুব সাবধানে ফরোয়ার্ড আর রিভার্সের মাধ্যমে ট্রলারের স্টার্নকে জালের পাশ থেকে সরিয়ে আনছে ম্যানফ্রেড। অবশেষে সবটুকু পার্স লাইন কপিকলে জড়িয়ে ফেললেন লোথার। নৌকার পাশ দিয়ে উঠে এল চকচকে স্টিল রিংয়ের গোছা। জালের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাগে উঠে এসেছে পুরো ঝাঁক।
গাল বেয়ে দরদর করে ঝরে পড়ছে ঘাম; ভিজে গেছে গায়ের শার্ট। গানওয়েলের পাশে হেলান দিয়ে বসলেন ক্লান্ত লোথার। এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন যে কথা বলার শক্তিও পাচ্ছেন না। কপাল আর চোখের ওপর লেপ্টে আছে ঘামে ভেজা রুপালি-সাদা চুল। হঠাৎ করে দা সিলভার দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলেন।
শীতল সবুজ বেনশুয়েলা স্রোতের ওপর পরিষ্কার একটা গোলাকার চক্র হয়ে ঘুরছে কর্ক লাইন। কিন্তু একটু জিরোবার আশায় বসতেই লোখারের চোখে পড়ল-নড়ে উঠেছে কর্ক লাইন। আকারেরও পরিবর্তন হচ্ছে। তার মানে এতক্ষণে জালের অস্তিত্ব টের পেয়েছে মাছের ঝাঁক। তাই ছাড়া পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। ভাসমান আগাছার মত দুলে উঠল পুরো জাল আর সাথে থাকা ডিঙ্গি।
ঠিক যেন লেভিয়াথানের শক্তি এসে ভর করেছে পুরো ঋকের ওপর।
“ওহ, খোদা, যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও বেশি মাছ উঠেছে।” হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়ালেন লোথার। চোখের ওপর থেকে ঘামে ভেজা চুল সরিয়েই দৌড় দিলেন দা সিলভার কাছে।
জালের ভেতর ছোটাছুটি করে পুরো ঝাঁক। পানির ঘূর্ণির ভেতর মোচার মত দুলছে ডিঙ্গি। ভারি লাইনে হ্যাঁচকা টান লাগাতে লোখারের পায়ের নিচে কেঁপে উঠল ট্রলারের ডেক।
“দা সিলভা ঠিকই বলেছিল। মাছগুলো উন্মাদ হয়ে গেছে।” ফিসফিসিয়ে নিজেকে শুনিয়েই ফ্যাহর্নের হ্যাঁন্ডেল ধরতে ছুটলেন লোথার। তীক্ষ্ণ সরে তিনবার বেল বাজালের সাহায্যের আশায়। তারপর আবার ডেকে দৌড়ে আসতে আসতে দেখলেন যে এরই মাঝে নাক ঘুরিয়ে এদিকে ছুটে আসছে। বাকি তিনটা নৌকা। এত বিশাল বড় ঝাক দেখে কেউই এখনো নিজেদের জাল ফেলতে সাহস করেনি।
“তাড়াতাড়ি! আরো জোরে আয় বাবারা!” অনর্থক ঘোঁতঘোঁত করে উঠলেন লোথার। তারপর নিজের ক্রুদের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বললেন, “যে যেখানে আছো, দৌড়ে আসো, জাল ধরতে হবে।”
কিন্তু নাবিকদের চেহারা দেখে বোঝা গেল যে সবাই দ্বিধা করছে। জালে কেউ হাত লাগাতে চায় না।
“হা করে কী দেখছো, হাত লাগাও পাজির দল!” সবাইকে চিৎকার করে লোথার নিজে গানওয়েলের উদ্দেশে লাফ দিলেন। সবাই মিলে ঝাঁকটাকে চেপে ধরতে হবে। যেন ছোট্ট মাছগুলো নড়াচড়া করার শক্তি না পায়।