সবার আগে নড়ে উঠল দা সিলভা। ঠিক একজন তরুণের মতই ঘুরে দাঁড়িয়ে ডেকের ওপর দিয়ে দৌড় দিল। হুইল হাউজের দরজায় দাঁড়িয়ে কেবল বলল, “মারীয়া, ঈশ্বরের মাতাকে ধন্যবাদ দাও যে তারপরেও দিনশেষে আমাদের একটা জাল অবশিষ্ট থাকবে।”
তীক্ষকণ্ঠে ভবিষ্যদ্বাণী করেই বুড়ো স্টানের দিকে দৌড় দিল। তারপর গানওয়েলের ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ডিঙ্গির ওপর চড়ে বসল। তার দেখাদেখি চঞ্চল হয়ে উঠল বাকি। সবাই যে যার স্থানের উদ্দেশে দৌড় লাগাল।
“ম্যানফ্রেড!” ছেলের উদ্দেশে হাঁক ছাড়লেন লোথার। পিতার ডাক কানে যেতেই পোর কিনার থেকে বাধ্যের মত চলে এল মোহাবিষ্ট ছেলেটা।
“হুইল ধরো।” কম বয়স্ক কারো জন্য এ দায়িত্ব অত্যন্ত বিশাল হলেও ম্যানফ্রেড এর আগেও বহুবার নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করাতে লোথার নিশ্চিন্তে হুইল হাউজ থেকে বেরিয়ে গেলেন। একবারও পিছন ফিরে না তাকিয়ে একের পর এক সিগন্যাল দিয়ে চললেন লোথার। বাবার ইশারা মতই ঝাকের চারপাশে চক্রাকারে ট্রলার নিয়ে ঘুরতে শুরু করল ম্যানফ্রেড।
“বড় বেশি মাছ।” আপন মনে ফিসফিসিয়ে উঠলেন লোথার। দূরত্ব, বাতাস ও স্রোতের গতি আর বুড়ো দা সিলভার সতর্কবার্তাকে মাথায় রেখে দক্ষ চোখে হিসাব কষে বের করলেন : বড়জোর ১৫০ টন আর ভাগ্য ভালো হলে ট্রলার আর জালের ধারণক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ২০০ টন পর্যন্ত মাছ ভোলা যাবে।
অথচ চোখের সামনে পানিতে নাচছে মিলিয়ন মিলিয়ন টন মাছের ঝাঁক। অবিবেচকের মত একটু ভুলচুক হলেই দশ থেকে বিশ হাজার টন মাছের ভারে ছিঁড়ে পড়বে জাল; এমনকি হ্যাঁচকা টানে পুরো ট্রলার উল্টে পড়াও বিচিত্র নয়। আর তাহলে যে শুধু দামি একটা জাল আর ট্রলার হারাবেন তা-ই নয়; ক্রু আর ছেলেকেও হারাবেন।
অবচেতনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই দেখলেন দাঁত বের করে হাসছে ম্যানফ্রেড। উত্তেজনায় চকচক করছে ছেলেটার চেহারা। গাঢ় হলুদাভ বাদামি রঙা চোখ আর উজ্জ্বল দাঁতের সারি দেখে মনে পড়ে গেল ওর মায়ের মুখ। মা ছেলে অবিকল একে অন্যের প্রতিচ্ছবি। কথাটা মনে হতেই তিক্ত মনে কাজে চলে গেলেন লোথার।
তবে খানিকক্ষণের এই অন্যমনস্কতার জন্য আরেকটু হলেই সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছিল। দ্রুতবেগে ধাবমান ট্রলার যেকোনো মুহূর্তে মাছের ঝাঁকের গায়ে ধাক্কা দেবে। আর ছোট্ট প্রাণীগুলোও এমন অদ্ভুতভাবে জোট বেঁধে আছে যেন একক সত্তা। ট্রলারের শব্দে একবার যদি গভীর সমুদ্রে উধাও হয়ে যায় তাহলেই কাজ সারা। তাড়াতাড়ি মোড় ঘোরানোর জন্য তীব্রভাবে ইশারা দিতেই দায়িত্ব পালন করল ম্যানফ্রেড। প্রায় পঞ্চাশ ফুট দূরত্বে সরে এসে সুযোগের অপেক্ষায় স্থির হল নৌকা।
চারপাশে দ্রুত একবার নজর বোলাতেই বুঝতে পারলেন বাকি ট্রলারগুলোর ক্যাপ্টেনদেরও একই অবস্থা। সোয়ার্ট হেনড্রিকের সাথে চোখাচোখি হল। বিশাল আর কালো মদ্দা ষাড়ের মত মানুষটার টাক মাথায় সূর্যের আলো পড়ে কামানের গোলার মত চকচক করছে। যুদ্ধ আর শত শত বেপরোয়া অভিযানের সঙ্গী সোয়ার্ট, লোথারের মতই স্থল থেকে জলে স্থানান্তরিত হয়ে দক্ষ এক জেলেতে পরিণত হয়েছেন। হাত দিয়ে ইশারা করে “সাবধান” আর “বিপদ” শব্দ দুটো দেখিয়ে দিলেন লোথার। নিঃশব্দে হাসি দিয়ে সম্মতিসূচকভাবে হাত নাড়লেন সোয়াট।
নর্তকীদের মতই সাবলীল তালে ঋকের চারপাশে ঘুরছে চারটা নৌকা। কুয়াশার শেষ আঁচড়টুকুও মিলিয়ে দিয়ে দিগন্তে উঠে গেল সূর্য।
কিন্তু এখনো একটুও আলগা হয়নি মাছের ঝাঁক। আস্তে আস্তে অধৈর্য হয়ে উঠছেন লোথার। সচরাচর যেটুকু থাকেন তার চেয়েও প্রায় এক ঘণ্টা বেশি সময় ধরে চক্কর কাটছেন। যেকোনো মুহূর্তে হয়ত মাছগুলো আবার হাওয়া হয়ে যাবে। অথচ একটা নৌকা থেকেও জাল ছোঁড়া হয়নি। সম্পদের খনি পেয়েও যেন কিছুতেই ছুঁতে পারছেন না। মরিয়া হয়ে উঠলেন লোথার, এমনিতে বহুক্ষণ কেটে গেছে।
“ধুত্তোরি, যা হবার হবে।” ম্যানফ্রেডকে আরো কাছে যাবার ইশারা দিলেন। কিন্তু বোকামিটা করার সাথে সাথে কানে এল দা সিলভার হুইসেল। বুড়ো পর্তুগিজের দিকে তাকাতেই দেখা গেল উন্মাদের মত হাত নাড়ছে। তাদের পেছনে ফুলে উঠেছে মাছের ঝাঁক। গোলাকার ঝকটা ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে। এতক্ষণ এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করছিল সকলে।
“ম্যানফ্রেড!” তীব্র গর্জন করেই ডান হাতটাকে উইন্ডমিলের মত ঘোরাতে লাগলেন লোথার। ছেলেটাও হুইল ঘুরিয়ে দিতেই তরতর করে এগিয়ে চলল নৌকা। জল্লাদের তলোয়ারের ফলার মত ঝাঁকের মধ্যে ঢুকে গেল ট্রলারের মাথা।
“গতি কমাও!” লোথার হাতের ঝাঁপটা দিতেই থেমে গেল নৌকা। নিচের পানি এত স্বচ্ছ যে প্রায় প্রতিটি মাছকে আলাদাভাবে দেখা যাচ্ছে।
লোথার আর ম্যানফ্রেড মিলে ট্রলারের বো’ এত সাবধানে ঝাঁকের মাঝে নিয়ে গেলেন যেন প্রপেলারও তেমন না নড়ে। নচেৎ আতঙ্কিত হয়ে ফিরে যাবে মাছের ঝক। বাবার ইশারামত কাজ করল ম্যানফ্রেড। ঝাঁকের ছোট একটা অংশ আলাদাও হয়ে গেল।
“কিন্তু এখনো বেশি!” বিড়বিড় করে যেন নিজেকেই শোনালেন লোথার। ঝাঁকের যে অংশটা আলাদা করা গেছে সেটা আকারে ক্ষুদ্র হলেও প্রায় হাজার টন মাছ আছে, অথবা এর চেয়েও বেশি। কারণ গভীরে কতটা আছে তা তো বোঝা যাচ্ছে না।