শাসার হাত ধরে পার্কিং লটে চলে এল তারা। দু’জনে পাশাপাশি বসলেও সাথে সাথেই ইঞ্জিন স্টার্ট করতে পারল না তারা। দুজনেই এত অবাক হয়ে গেছে যেন বোধবুদ্ধি কিছুই কাজ করছে না।
“আমার তো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না।” ফিসফিস করে করে উঠল তারা।
“আমার মনে হচ্ছে আমি একটা লাইনচ্যুত ট্রেনে বসে আছি। অন্ধকার এক টানেলে ছুটে চলেছে ট্রেন যেখান থেকে ফেরার কোনো রাস্তা নেই।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাসা বলল, “আহারে বেচারা সাউথ আফ্রিকা; ঈশ্বরই জানেন এর ভাগ্যে কী আছে।”
***
মোজেস গামার চারপাশেও বেশ ভিড় জমে গেছে। সোয়ার্ট হেনড্রিকও আছে।
রুমে ধোয়া ওঠা একটা মাত্র প্যারাফিন ল্যাম্পের হলুদ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আছে মোজেসের চেহারা।
“ও আসলেই একটা সিংহ” আপন মনেই প্রাচীন রাজাদের স্মরণ করলেন হেনড্রিক; উনারাও নিশ্চয় এভাবেই যুদ্ধের আদেশ দিতেন।
“বোয়ারা এখন নিজেদের বিজয়ে নাচছে” বলে উঠলেন মোজেস, “কিন্তু আমার সন্তানেরা, তোমরা জেনে রাখো যে তাদের এই আত্মগরিমা আর লালসাই তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। হয়ত কাজটা তেমন সহজ হবে না। অনেক পরিশ্রম এমনকি রক্তও ঝরাতে হতে পারে কিন্তু আগামীকালের ভবিষ্যৎ হবে আমাদের।”
***
ইউনিয়ন বিল্ডিংয়ে তার অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন নতুন ডেপুটি মিনিস্টার অব জাস্টিস।
বাইরে রাত নেমেছে। তাই বেশিরভাগ অফিসেই জ্বলে উঠেছে আলো। সবাইকেই অনেক রাত অব্দি কাজ করতে হয়। ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করে লাগাম ধরে রাখা সোজা কথা নয়। কিন্তু ক্লান্তি বলতে কিছু জানে না ম্যানফ্রেড ডি লা রে। তাকে কেন নির্বাচন করা হয়েছে তা সে ভালোভাবেই জানে। যদিও অনেকেই ডেপুটি মিনিস্টার পদের জন্য তার বয়স একটু বেশিই তরুণ বলে মনে করে। যাই হোক, ম্যানফ্রেড ওদেরকে ভুল প্রমাণ করেই ছাড়বে।
মিনিস্টারের দরজায় নক করতেই ভেতরে থেকে আদেশ এল, “এসো।”
চার্লস রবার্টস এমনভাবে হাসলেন যেন গ্রানাইটের স্ল্যাবে ফাটল দেখা দিল, “ম্যানফ্রেড, তোমাকে যে ছোট্ট উপহারটা দিব বলে প্রমিজ করেছিলাম সেটা নাও।” ডেস্কের উপর দিয়ে ম্যানফ্রেডের দিকে একটা খাম বাড়িয়ে দিলেন “ব্ল্যাকি” সোয়ার্ট।
“আমি যে কতটা কৃতজ্ঞ আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না মিনিস্টার।” খামটা হাতে নিল ম্যানফ্রেড। “আশা করছি এর বিনিময়ে সামনের বছরগুলোতে বিশ্বস্ততা বজায় রেখে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের আনুগত্য তুলে ধরতে পারব।”
নিজের অফিসে চলে এল ম্যানফ্রেড। তারপর সাবধানে খামটা খুলে বের করল ভেতরের সব কাগজ। আস্তে আস্তে সযত্নে পড়ল প্রতিটি পৃষ্ঠা।
শুরুতেই পড়ল বিভিন্ন অপরাধে যাবজ্জীবন সাজা ভোগকারী কোনো একজন লোথার ডি লা রে’র মুক্তির আদেশনামা।
কাগজটাকে ভাজ করে আবার খামে ভরে রেখে দিল ম্যানফ্রেড। আগামীকাল নিজ হাতে কারাগারের গভর্নরের হাতে দিবে এই দলিল আর তারপর বাবার হাত ধরে নিয়ে আসবে বাইরে, খোলা আকাশের নিচে।
এরপর আবার ডেস্ক থেকে উঠে সেইফের কাছে গিয়ে খুলে ফেলল কম্বিনেশন লক লাগানো ভারি স্টিলের দরজা। একেবারে উপরের তাকে পড়ে আছে তিনটা ফাইল। সবগুলো ফাইল এনে ডেস্কের উপর রাখল ম্যানফ্রেড। এর একটা পেয়েছে সামরিক গোয়েন্দাবাহিনির কাছ থেকে আরেকটা সিআই ডি হেড কোয়ার্টারস আর বাকিটা তার নিজের আইন মন্ত্রণালয় থেকে এসেছে। তবে এই তিনটা ফাইলকেই একসাথে ওর ডেস্কে পাওয়ার জন্যে ব্যয় হয়েছে দীর্ঘ সময় আর অত্যন্ত সতর্ক এক পরিকল্পনা। আর্কাইভ রেজিস্টার থেকেও মুছে দিতে হয়েছে এগুলোর অস্তিত্ব। একমাত্র এগুলোর মাঝেই এখনো টিকে আছে হোয়াইট সোর্ড।
বহু সময় লাগিয়ে মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি ফাইল পড়ল ম্যানফ্রেড। শেষ করতে করতে মাঝরাত পেরিয়ে গেল। কিন্তু স্বস্তি পেল এটা জেনে যে, “হোয়াইট সোর্ড” আর অলিম্পিক গোল্ড মেডালিস্ট ও বর্তমান ডেপুটি মিনিস্টার অব জাস্টিসের মাঝে কেউ কোনো যোগসূত্র খুঁজে পায়নি।
তিনটা ফাইল তুলে নিয়ে বাইরের আরেকটা অফিসে এসে স্রেডিং মেশিন চালু করল ম্যানফ্রেড। প্রতিটি পাতা আলাদা আলাদা করে মেশিনে দিতেই কুচি কুচি হয়ে গেল সবকটা ফাইল। নুডলসের মত চিকন দলা পাকানো কাগজের স্তূপ দেখে মনে পড়ে গেল ফাইলের একটা অংশ;
“তার মানে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে।” আপন মনেই বিড়বিড় করে উঠল ম্যানফ্রেড, “আফ্রিকান ভাষায় কথা বলা তরুণী এক মেয়ে প্রিটোরিয়ার অস্ত্র থেকে শুরু করে পর্বতের অ্যাম্বুশ পর্যন্ত সবকিছু জানত। আর এরকম একজন তরুণীই আছে যে সবকিছু জানে।” কোনো এক সময় তাহলে তাকেও উচিত শাস্তি দিতে হবে, কিন্তু ঠিক আছে; ম্যানফ্রেডের কোনো তাড়াহুড়া নেই, আরো অনেক কিছুর সমাধান করতে হবে; অনেক ঋণ শোধ করতে হবে।
একেবারে শেষ পাতাটাকেও বিনষ্ট করে অফিস থেকে বেরিয়ে এল ম্যানফ্রেড। পার্কিং লটে অপেক্ষা করছে নতুন কালো ফোর্ড সেডান।
গাড়ি চালিয়ে চলে এল ওয়াটার কুফের অভিজাত সরকারি বাসভবনে। উপরে যাওয়ার সময় অবশ্য সতর্ক থাকতে হল যেন হেইডির ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। কারণ ম্যানফ্রেড আবারো বাবা হতে চলেছে।
অন্ধকার বিছানায় শুয়ে পড়লেও ঘুমাতে পারল না ম্যানফ্রেউ। সামনে শত শত কাজ; কাজের পরিকল্পনা। এরই ফাঁকে একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ায় আবার হেসেও ফেলল; ভাবল, “তো, অবশেষে আমাদের হাতেই এল ক্ষমতা, এবার দেখা যাবে প্রতিপক্ষ কী করে।”