পাঁচটারও অনেক সময় বাদে ভ্যান স্কুর আর ম্যানফ্রেড ডি লা রে’র ল’ অফিসের সামনে পৌঁছে গেলেন। সদর দরজা স্পর্শ করতেই দেখা গেল একজন এখনো কাজ করছেন। লোকটা জানাল,
“ডি লা রে আজ একটু তাড়াতাড়িই বাসায় ফিরে গেছেন। কারণ নিরিবিলিতে কাজ করতে চান।”
“আমার প্রয়োজনটাও খুব জরুরি, প্লিজ তার বাসার ঠিকানা?”
লানজেরাকে এস্টেটের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নদীর তীরে এক একর নিয়ে তৈরি বাড়িটা। বোঝা যাচ্ছে, বাড়ির মালিক বাগান সম্পর্কেও বেশ যত্নশীল।
সোনালি চুলের বড়সড় এক নারী দরজাটা খানিক ফাঁক করে খুলে দিতেই সেনটেইন জানালেন, “আমি মঁসিয়ে ডি লা রে’র সাথে কথা বলতে চাই। উনাকে কি গিয়ে বলবেন যে মিসেস ম্যালকমস্ এসেছেন?”
“আমার হাজব্যান্ড তো কাজ করছেন। আমি যদিও তাকে বিরক্ত করতে চাই না, তারপরেও ভেতরে আসুন। দেখা যাক আপনার সাথে কথা বলতে রাজি হয় কিনা।”
সামনের রুমে ঢুকে দাঁড়িয়েই রইলেন সেনটেইন। অন্যমনস্ক হয়ে তাকালেন ফায়াপ্লেসের উপরকার পেইন্টিংসগুলোর দিকে। আচমকা কী মনে হতেই ঘুরে দাঁড়ালেন।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাকে অপলক চোখে দেখছে একটা ছোট্ট শিশু। সাত আট বছরের ছেলেটা দেখতেও বেশ সুদর্শন, মাথাভর্তি সোনালি চুল; কিন্তু চোখ দুটো তার।
সাথে সাথে বুঝে গেলেন যে বাচ্চাটা তারই দৌহিত্র। এতটাই চমকে গেলেন সেনটেইন যে, কেবল পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
খানিক বাদে সম্বিত ফিরতেই আস্তে আস্তে ওর কাছে গেলেন। হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাসিমুখে বললেন, “হ্যালো। তোমার নাম কী?”
“আমি লোথার ডি লা রে।” বেশ গম্ভীরভাবে উত্তর দিয়ে ছোট্ট মানুষটা বলে উঠল, “আর আমার বয়স প্রায় আট।”
“লোথার!” নামটা শোনার সাথে সাথে হুড়মুড় করে মনে পড়ে গেল গত জনমের সব স্মৃতি। তারপরেও হাসি মুখে সেনটেইন বললেন, “তাই নাকি বাহ তুমি তো বেশ বড় কথা বলার সময় আলতো করে লোথারের গাল স্পর্শ করতে যাবেন আর সে সময়েই পেছনের দরজায় দেখা দিল ওর মা।
“তুমি এখানে কী করছে লোথার? ডিনার কে শেষ করবে শুনি, এক্ষুণি টেবিলে যাও বলছি।”
ত্রস্তপায়ে ভেতর দিকে দৌড় দিল লোথার। সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে হাসল ওর মা।
“ও আপনাকে বিরক্ত করছিল নিশ্চয়। অ্যায়াম সরি। আমার সাথে আসুন। আমার হাজব্যান্ড আপনার সাথে দেখা করবেন।”
একটু আগেই লোথারকে দেখে আবেগআপ্লুত সেনটেইন বিস্মিতভাবে এগোলেন ম্যানফ্রেডের সাথে দেখা করার জন্য।
কাজগপত্রে বোঝাই একটা ডেস্ক থেকে হলুদ দুখানা চোখ মেলে মায়ের দিকে তাকাল ম্যানফ্রেড।
“আপনাকে এ বাড়িতে স্বাগত জানাতে পারছি না মিসেস ম্যালকমস,” ইংরেজিতে বলে উঠল, “আপনি আমার আর আমার পরিবারের এক জাতশত্রু।”
“এ কথা সত্য নয়।” সেনটেইনের মনে হল যেন দম বন্ধ হয়ে মরে যাবেন। কোনোরকম হাঁপাতে হাঁপাতে চাইছেন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে।
বিরক্তির ভঙ্গি করে ম্যানফ্রেড বলল, “আপনি আমার বাবার সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তাকে ধোকা দিয়েছেন, পঙ্গু বানিয়ে ফেলেছেন আর আপনার জন্যই আজ এত বছর ধরে সে জেলে। তাকে আজ এ অবস্থায় দেখলে আমার কাছ থেকে কোনো দাক্ষিণ্য নিতে আর আসতেন না আপনি।”
“তুমি নিশ্চিত যে, আমি তোমার দাক্ষিণ্য চাইতে এসেছি?”
ঘর কাঁপিয়ে হেসে ফেলল ম্যানফ্রেড, “আর কোন কারণ আছে নাকি? আপনি আমাকে সব সময় সব জায়গায় তাড়া করে এসেছেন, বাবার বিচারের দিন প্রথম যেদিন কোর্টরুমে আপনাকে দেখেছি সেদিন থেকে সর্বদা আমার পিছু নিয়েছেন এক ক্ষুধার্ত সিংহীর মত; যেন বাবার মত আমাকেও শেষ করে দিতে পারেন, তাই না?”
“না!” তীব্রভাবে মাথা নাড়লেন সেনটেইন। কিন্তু ম্যানফ্রেড আজ নির্দয়ের সীমা পার হয়ে গেল, “আর এখন আবার এসেছেন আমার কাছে দয়া চাইতে। জানি আপনি কী চান।” ডেস্কের ড্রয়ার খুলে একটা ফাইল বের করে রাখতেই ডেস্কের উপরে ছড়িয়ে পড়ল একগাদা কাগজ আর ছবি। এগুলোর মধ্যে ফরাসি বার্থ সার্টিফিকেট আর পুরনো নিউজ পেপারের ক্লিপিংও দেখতে পেলেন সেনটেইন।
“এগুলো আপনাকে পড়ে শোনাবো নাকি আপনি নিজেই পড়বেন? দুনিয়াকে দেখানোর জন্য আমার আর কী প্রমাণ চাই যে আপনি একটা বেশ্যা আর আপনার ছেলেও অবৈধ?” শব্দটা শুনেই কুঁকড়ে উঠলেন সেনটেইন।
“তুমি তো বেশ ভালোই হোমওয়ার্ক করেছো।” নরম স্বরে জানালেন সেনটেইন।
“ইয়েস। আমার কাছে সব প্রমাণ আছে “
“না।” বাধা দিলেন সেনটেইন, “সব প্রমাণ নেই। তুমি শুধু আমার একটা অবৈধ সন্তানের কথা জানোনা, কিন্তু আরেকজনও আছে। চলো তোমাকে দ্বিতীয় অবৈধজনের গল্প বলি।”
প্রথমবারের মত খেই হারিয়ে একদৃষ্টে সেনটেইনের দিকে তাকাল ম্যানফ্রেড। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “আপনি এত বেহায়া। দুনিয়ার সামনে নিজের কুকীর্তি বলতেও পিছপা হন না।”
“দুনিয়ার সামনে নয়, যার প্রয়োজন কেবল তার সামনে। তোমার সামনে ম্যানফ্রেড ডি লা রে।”
“মানে? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
“তাহলে শোন আমি কেন তোমাকে অনুসরণ করেছি, যেমনটা তুমি বললে ক্ষুধার্ত সিংহীর মত তোমার পিছু নিয়েছি; শিকারের জন্য নয়, সন্তানের দেখা পাওয়ার জন্য। তুমিই, ম্যানফ্রেড, আমার আরেক সন্তান। মরুভূমিতে তোমাকে জন্ম দেয়ার পরপরই লোথার তোমাকে নিয়ে গেছেন। শাসা তোমারই সৎভাই। ও যদি অবৈধ হয়, তুমিও তাই। আর এই কারণে যদি ওকে ধ্বংস করতে চাও তাহলে নিজেকেও ধ্বংস করবে।”