***
জেগে জেগে বোমারুবিমানের গর্জন শুনছে হেইডি ডি লা রে। তারপর তিন রাত ধরে চলছে এই গোলাবর্ষণ। ধ্বংস হয়ে গেছে শহরের কেন্দ্রস্থল। এটাও কানে এসেছে যে ফ্রান্স আর রাশিয়াতে জিতে গেছে মিত্রবাহিনি। আরেকটা নির্দয় সত্য হল মিনস্কে রাশানদের হাতে ধরা পড়েছে হাজার হাজার জার্মান সেনা।
হেইডির পাশেই শুয়ে অস্থিরভাবে নড়াচড়া করছেন কর্নেল সিগমন্ড বোন্ড। কিছুদিনের মধ্যেই পুরোপুরি ধসে পড়বে তার ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি। তখন ছোট্ট লোথার আর তার ফুড রেশনের কী হবে ভেবে হেইডিও চিন্তায় পড়ে গেল।
আবারো কান পেতে বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শুনল। রেইড শেষ হয়ে যাওয়ায় মশার পিনপিন গুঞ্জনের মত করে দূরে সরে যাচ্ছে বোমারুবিমান। কিন্তু ও জানে যে ওরা ঠিক আবার ফিরে আসবে। অন্ধকারে শুয়ে ম্যানফ্রেডের কথাও ভাবল হেইডি। মনে পড়ল সেসব চিঠির কথা যেগুলোর জবাব ও দেয়নি। ছেলেটা এখন লিসবনে আছে আর পর্তুগালে কোনো বোমারুবিমান নেই।
পরদিন সকালবেলা নাশতা খাওয়ার সময়ে কনেকে কথাটা জানাল; বলল, “আমি শুধু ছোট্ট লোথারের কথা চিন্তা করছিলাম।” সাথে সাথে কর্নেলের চেহারায় স্বস্তির ছাপ দেখা গেল। এক বছর ধরে হেইডিকে মিসট্রেস হিসেবে ব্যবহার করলেও এখন যেন ছাড়তে পারলেই বাঁচেন। সেই সন্ধ্যাতেই ম্যানফ্রেডের কাছে ছবি আর চিঠি পাঠাল হেইডি।
দ্রুত কাজ সারলেন কর্নেল। নিজের প্রভাব খাটিয়ে এক সপ্তাহের ভেতরেই ট্রাভেল পাস্ জোগাড় করে জাঙ্কারস ট্রান্সপোর্ট এয়ার ক্রাফটে তুলে দিলেন হেইডি আর লোথারকে।
তিনদিন বাদে গ্রুয়েনে ওয়ার্ল্ডে নিজ বাড়িতে বন্দি হলেন কর্নেল। এক সপ্তাহ পরে গেস্টাপো হেড কোয়ার্টারে মারা গেলেন ফুয়েরারকে হত্যা করার পরিকল্পনায় শামিল থাকার অপরাধে। যদিও নিজের নির্দোষিতার পক্ষে জোর দিয়ে গেছেন কর্নেল।
***
ধোয়া ছেড়ে টেবিল বে’তে যাওয়ার সময় পর্তুগিজ জাহাজের রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে আফ্রিকাকে প্রথম দেখল ছোট্ট লোথার ডি লা রে। বাবা-মায়ের হাত ধরে আনন্দে চিৎকার করছে লোথার।
দুই বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে যুদ্ধ। তারপরেও পরিবার নিয়ে আফ্রিকাতে ফেরার আগে বিস্তর সাবধানতা অবলম্বন করেছে ম্যানফ্রেড। যুদ্ধ শেষে মুক্তি পেয়েছেন আংকেল ট্রম্প আর রুলফ। তাই পারিবারিক সব খবর ভালো।
রাজনৈতিক সংবাদও যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। ডা, ডেনিয়েল মালানের অধীনে গঠিত ন্যাশনাল পার্টিতে প্রাক্তন ওবি সদস্যরা সবাই যোগ দিয়েছে।
স্মুটস আর তার ইউনাইটেড পার্টির বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষও ঘোট পাকাচ্ছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে স্মাটস দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়েও বেশি ব্রিটিশদের স্বার্থ নিয়ে ভাবেন।
তার উপরে ব্রিটিশ রয়্যাল ফ্যামিলিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভ্রমণের নিমন্ত্রণ জানানোতেই সকলে বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছে। ডা. ডেনিয়েলের সদস্যরা তো সংসদে, রাজকীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিতই হননি।
সবশেষে আংকেল চিঠি শেষ করলেন এই লিখে যে, “বহু ঝড়-ঝা পেরিয়ে আজ আমরা আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আর শক্তিশালী ম্যানি। ঘরে ফিরে এসো। এখন তোমার মত লোকই প্রয়োজন।”
তারপরেও সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেছে ম্যানফ্রেড { আংকেলের কাছে চিঠি লিখে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছে যে, দেশে হোয়াইট সোর্ডের কথা কেউ জানে না। পুলিশ বাহিনির বন্ধুদের কাছ থেকেও খবর পেল যে তদন্ত এখন একেবারই বন্ধ। যদিও ফাইলটা ঠিকই ওপেন আছে। কিন্তু হোয়াইট সোর্ড সম্পর্কে মিইয়ে গেছে সকলের আগ্রহ।
এরপর স্ত্রী-পুত্রকে লিসবনে রেখে জুরিখে গিয়ে বাকি হিরে বিক্রি করে দিল ম্যানফ্রেড। প্রায় দুই লাখ পাউন্ডও জমা করে দিল সুইস এক অ্যাকাউন্টে।
কেপটাউনে পৌঁছাবার পরেও তেমন একটা শোরগোলের মধ্যে গেল না ওর পরিবার। সন্তর্পণে বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন, ওবি সদস্যদের সাথে দেখা করে নিশ্চিত হয়ে নিল যে কেউই তার প্রতি তেমন নাখোশ নয়। পরে বার্গার সংবাদপত্রে ছাপা হল অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী মানফ্রেড ডি লা রের প্রথম ইন্টারভিউ। যুদ্ধে নিরপেক্ষ পর্তুগালে থাকলেও এবার দেশের জন্য কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করল ম্যানি।
সুদর্শন ম্যানফ্রেড অত্যন্ত বুদ্ধিমানও বটে। উচ্চ পর্যায়ে বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যাও দিনকে দিন বাড়ছে। স্টিলেবশ ল’ ফার্মের অংশীদারিত্ব কিনতেও তাই কোনো ঝামেলা হল না। সিনিয়র পার্টনার অ্যাটর্নি ভ্যান স্কুর মাধ্যমে ন্যাশনালিস্ট পার্টিতেও জায়গা করে নিল।
একাগ্রচিত্তে কেপ ন্যাশনালিস্ট পার্টির হয়ে কাজকর্ম শুরু করে দিল ম্যানফ্রেড। সংগঠক আর তহবিল সংগ্রাহক হিসেবেও খ্যাতি জুটে গেল। ফলে ১৯৪৭ সালে পেল ব্রাদারহুড নামক আরেক গোপন আফ্রিকান সংগঠনের সদস্যপদ।
কেবলমাত্র অত্যন্ত মেধাবী আর চৌকষ ব্যক্তিরাই হতে পারে এটার সদস্য। একই সাথে সেই সদস্যের শরীরে থাকতে হবে বিশুদ্ধ আফ্রিকান রক্ত। তাছাড়া মানুষের মাঝে তার জনপ্রিয়তাও থাকতে হবে।
১৯৪৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের ক্যাম্পেইনেই এ সুযোগ পেয়ে গেল ম্যানফ্রেড। তৃণমূল পর্যায়ে ইটেনটটস হল্যান্ডের ক্যান্ডিডেট হয়ে গেল ম্যানফ্রেড ডি লা রে।
দুই বছর আগে এই আসন পেয়েছিল ধনী আর ইংরেজি ভাষী কেপ ফ্যামিলি থেকে আসা এক ওয়্যার হিরো। ইউনাইটেড পার্টি সেই শাসা কোর্টনিকে সাধারণ নির্বাচনে তাদের দলের মনোনয়ন প্রদান করেছে।