নির্ভুলভাবে এগিয়ে গেল গ্রানাইটের সেই ফাটলের দিকে। কিন্তু হাঁটু গেড়ে বসতেই কেঁপে উঠল বুক। কারণ ভেতরে এত অন্ধকার যে আলাদা করে কিছুই চোখে পড়ছে না।
“তো, বিখ্যাত সেই হিরেগুলো আর নেই, তাই না।” ম্যানফ্রেডের হতাশ মুখ দেখে মিটিমিটি হাসলেন হেনড্রিক, “হয়ত শেয়াল খেয়ে ফেলেছে।”
তাঁর কথায় পাত্তা না দিয়ে ব্যাগ থেকে ফিশিং লাইনের বান্ডেল বের করল ম্যানি। মাছ ধরার হুক লাগিয়ে নিচে ফেলে দিল বঁড়শি। এরপর ধৈর্য সহকারে লাইনটাকে গভীর অন্ধকারে এদিক-সেদিক ঘোরাতে লাগল।
অন্যদিকে ছায়ার মাঝে বড়সড় একটা পাথর বেছে নিয়ে উবু হয়ে বসে ওর কাজ দেখতে লাগল হেনড্রিক। যদিও কোনো সাহায্য কিংবা উৎসাহও দিচ্ছে না।
ফাটলের ভেতরে বহু নিচে কিছু একটাতে হুক আটকে গেছে বুঝতে পেরে আস্তে করে লাইন টানা শুরু করল ম্যানি। বোঝা যাচ্ছে জিনিসটা ভারি। ফলে একটু পরেই খুলে এল বঁড়শি। কিন্তু সাথে করে পচা ক্যানভাসের টুকরাও নিয়ে এসেছে।
তাই আবার বঁড়শিটাকে ফাটলের মধ্যে ফেলে দিল। প্রতিটি পাশে ইঞ্চি ইঞ্চি করে খুঁজছে ম্যানফ্রেড। ফলে আধঘণ্টা পরিশ্রমের শেষে আবারও কিছু একটাতে বিধে গেল বঁড়শি।
এবার সাথে সাথে টান না দিয়ে একটু একটু করে লাইন ঢিলে করে করে টানল। গ্রানাইটে ঘষা খাচ্ছে কিছু একটা খানিক বাদে উঠে এল আকারহীন একটা পোটলা। শেষ কয়েক ফুট তত উত্তেজনায় প্রায় নিঃশ্বাস নিতেই ভুলে গেল ম্যানি। অবশেষে উপরে উঠে এল ক্যানভাসের পুরনো একটা ব্যাগ। খুলতেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল অত্যুজ্জ্বল হীরে।
আগেই প্ল্যান করা ছিল যে হিরেগুলোকে সমান দুই ভাগে ভাগ করা হবে। তারপর প্রথম চয়েস জিতে হেনড্রিক নিজের পছন্দের ভাগটা নিয়ে নিতেই খালি তামাকের প্যাকেটে নিজের হিরেগুলোকে ভরে নিল ম্যানফ্রেড।
“তুমি সত্যি কথাই বলেছিলে লিটল ম্যানি, আমিই বিনা কারণে তোমাকে সন্দেহ করেছি।” স্বীকার করলেন হেনড্রিক।
পরের দিন সন্ধ্যায় দুজনে একসাথে নদীতীরে আগুন জ্বেলে পাশাপাশি ঘুমালেন। তারপর সকাল হতেই পরস্পরের বিদায় জানাবার সময় ম্যানি বলল, “গুডবাই হেনি, হয়ত কখনো আবার দেখা হয়ে যাবে।”
“আমি তো তোমাকে বলেছিই লিটন ম্যানি, মরুভূমির দেবতা আমাদেরকে একত্রে বেঁধে রেখেছেন। তাই আমি নিশ্চিত যে আমাদের আবার দেখা হবে।”
“আমিও তাহলে অপেক্ষা করব।”
“ঈশ্বরই কেবল সিদ্ধান্ত নিবেন যে আমরা কি পিতা-পুত্র নাকি ভাই অথবা পরস্পরের শত্রু হিসেবে উদয় হব।” কাঁধের ওপর নিজের ঝোলা নিয়ে সোজা দক্ষিণের মরুভূমির দিকে হাঁটা ধরলেন হেনড্রিক। একবারও পিছন ফিরে তাকালেন না।
হেনড্রিক চোখের আড়ালে যেতেই উত্তর-পশ্চিমের দিকে পা বাড়াল ম্যানি। সন্ধ্যার দিকে ক্যানুতে করে পর্তুগিজেও চলে এল। এর তিনদিন পরে পৌঁছে গেল লুয়ান্ডা। সোজা এসে বেল বাজাল জার্মান কনস্যালেটের গেইটে।
বার্লিন থেকে আদেশ আসার জন্য এখানেই পড়ে থাকল তিন সপ্তাহ। পরে বুঝতে পারল যে এই বিলম্ব আসলে ইচ্ছেকৃত। কারণ ও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। যা নাজি জার্মানিতে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
নিজের অংশ থেকে একেবারে পানির দরে বেঁচে দিল ছোট্ট একটা হিরে। আর অপেক্ষা করল কখন ডাক আসে।
দিনের বেশিরভাগ সময় ওয়ার্টার ফ্রন্ট ক্যাফেতে বসে কাটিয়ে দেয় ম্যানফ্রেড, রাতটা কোনো স্বস্তাদরের হোটেলে। বারবার ভাবতে চেষ্টা করে কোথায় ওর ভুল ছিল। মনে পড়ে আংকেল ট্রম্প, রুলফ, হেইডি আর বার্লিনে বাচ্চাদের কথা।
অবশেষে এল সেই অর্ডার। ওকে একটা জার্মান ডিপ্লেম্যাটিক পাসপোর্ট দিয়ে পর্তুগিজ জাহাজে উঠিয়ে দেয়া হল। যার মাধ্যমে ক্যানারি আইল্যান্ড পর্যন্ত যাওয়া যাবে। সেখান থেকে লিসবন।
লিসবনে পৌঁছেও একই রকম অবহেলা পেল ম্যানফ্রেড। ওকে বলা হল নিজের আশ্রয় খুঁজে নিয়ে অপেক্ষা করার জন্য। তাই হেইডি আর কর্নেল সিগমন্ড বোল্ডকে ব্যক্তিগতভাবে চিঠিও লিখল। কিন্তু কনস্যুলেট অ্যাটাশে চিঠিগুলো বার্লিনে পাঠানোর আশ্বাস দিলেও কোনো উত্তর পেল না ম্যানফ্রেড।
আরেকটা ছোট হিরেও তাই বিক্রি করে দিল। তাগাস নদীর তীরে সুন্দর একটা হোটেলে ঘর ভাড়া করে কাটাতে লাগল অলস সময়। দুটো বই লেখার কাজেও হাত দিল। একটা দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনৈতিক ইতিহাস আর আরেকটা আত্মজীবনী। একই সাথে বসবাসরত এক রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টারের কাছ থেকে শিখে নিল পর্তুগিজ ভাষা। পাশাপাশি বক্সিং প্র্যাকটিসটাও চালু রাখল। তারপরেও দুনিয়া জোড়া লড়াইয়ের অংশ নিতে পারছে না ভেবে আক্ষেপ কিছুতেই কাটাতে পারল না।
এদিকে জিততে চলেছে অক্ষশক্তি। কোলনে বোমা ফেলে ধ্বংস করে দিয়েছে ইউ এস। আবারো হেইডিকে চিঠি লিখল ম্যানফ্রেড।
এর তিন সপ্তাহ পরে জার্মান কনস্যুলেটে ঢু মারতেই মিলিটারি অ্যাটাশে ওকে একটা খাম ধরিয়ে দিল। হেইডির হাতের লেখা দেখে তো যেন খুশিতে আকাশে উড়ে গেল ম্যানি। কিন্তু মেয়েটা লিখেছে যে ওর আগের একটাও চিঠি না পেয়ে ধরেই নিয়েছিল যে ম্যানফ্রেড মারা গেছে। যাই হোক, ছোট্ট লোথারকে নিয়ে ভোলা নিজের একটা ছবিও পাঠিয়েছে হেইডি। পুত্র স্নেহে বিষণ্ণ হয়ে পড়ল ম্যানফ্রেড। সাথে সাথে লম্বা এক আবেগঘন চিঠিতে হেইডিকে জানিয়ে দিল যেন ট্রাভেল পাস জোগাড় করে লিসবন চলে আসে। ম্যানফ্রেড এখন যে সচ্ছল আর স্ত্রী-পুত্রকে চালাতে সক্ষম সেটাও লিখে দিল। আরো জানাল ভবিষ্যৎ নিয়ে সুন্দর সব পরিকল্পনার কথা।