“আজও যেন তাই হয়।” কুয়াশার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে নিঃশব্দে প্রার্থনা করলেন লোথার। আমার প্রার্থনা শোনো, ঈশ্বর! প্লিজ।” আর মাত্র তিনটা মাস প্রয়োজন, তাহলেই সমস্ত ঋণ শোধ করে তিনি আবার মুক্ত হতে পারবেন।
“ওই তো, কেটে যাচ্ছে।” ছেলেটার কথা কানে যেতেই চোখ পিটপিট করে মাথা নাড়লেন লোথার।
থিয়েটারের পর্দার মত ঘন কুয়াশা সরে যেতেই দেখা গেল অত্যন্ত নাটকীয় আর শ্বাসরুদ্ধকর এক দৃশ্য। সকালের উজ্জ্বলতা আর ধোঁয়া মিলেমিশে শুরু হল আতশবাজির খেলা। একসঙ্গে এত রঙের সম্মিলন যেন কিছুতেই প্রাকৃতিক বলে মনে হচ্ছে না। সমুদ্রের পানি থেকে ঝিলিক দিয়ে উঠছে কমলা, সোনালি আর সবুজ বর্ণচ্ছটা। রক্তলাল আর গোলাপি আভায় ভরে উঠেছে কুয়াশা। স্রোতের গায়ে শুরু হয়েছে আগুনের নাচন। জাদুকরী এই দৃশ্য দেখে ভারি হয়ে উঠেছে চারপাশের নীরবতা। অসাড় হয়ে গেছে যেন শরীরের সমস্ত ইন্দ্রিয় আর অনুভূতি। চোখ মেলে দুজনেই সবিস্ময়ে দেখল এই অপার্থিব দৃশ্য।
আর ঠিক তখনই উদয় হল সূর্য দেবতা। অত্যন্ত উজ্জ্বল সোনালি আলোয় ধসে পড়ল কুয়াশার ছাদ। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে স্রোতের রেখা। মেঘরঙা নীল মিশে উপকূলীয় পানি একেবারে তেলের মতই মসৃণ আর শান্তভাবে টলটল করছে। যেখানটাতে সত্যিকারের সামুদ্রিক স্রোতের সাথে মিশে গেছে সেই রেখাটা যা ঠিক একটা ছুরির ফলার মতই সোজা আর তীক্ষ্ণ। এর ওপারে আছে সীমাহীন অন্ধকার, যেন সবুজ এক ভেলভেট।
ফোরডেক থেকে শোনা গেল দা সিলভা’র গলা। দূরের কৃষ্ণকালো পানির দিকে চেয়ে নাচছে, “ওই তো লাফ দিয়েছে।”
পানির মধ্যে লাফিয়ে উঠল একটা মাছ। লম্বায় একটা মানুষের হাতের চেয়ে খানিকটা বড় হবে; চকচকে রূপার ছোট্ট একটা টুকরা। “ইঞ্জিন চালু করো।” উত্তেজনায় কাঁপছে লোথারের গলা। ছেলেটা হাতের কফি মগটাকে ঠাস করে চার্ট-টেবিলের ওপর রেখেই মই বেয়ে নিচের ইঞ্জিনরুমে দৌড় লাগাল। চারপাশে ছিটিয়ে পড়ল শেষ কয়েক ফোঁটা কফি।
একের পর এক সুইচ চালু করে থ্রটল ঠিক করে নিলেন লোথার। নিচে ক্রাংক হ্যাঁন্ডেলের ওপর ঝুঁকে আছে ছেলেটা।
“ঘোরাও।” লোথারের চিৎকার শুনেই চারটা সিলিন্ডারের বিরুদ্ধে সবলে যুদ্ধ করল ছেলেটা। ওর বয়স এখনো তেরো না হলেও ঠিক একজন পুরুষের মতই শক্তিশালী, আর কাজ করার সময় পেছনে ফুলে উঠেছে পেশি।
হালের পাশের এগজস্ট পাইপ দিয়ে প্রথমে খানিকটা তেল চিটচিটে কালো ধোঁয়া বেরোলেও একটু পরেই নিয়মিত ছন্দে চলতে শুরু করল ইঞ্জিন।
পড়িমরি করে মই বেয়ে ডেকে উঠে এল ছেলেটা। দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালো দা সিলভার পাশে।
স্রোতের মধ্য দিয়ে তরতর করে এগিয়ে চলল লোথারের ট্রলার। কুয়াশা পুরোপুরি কেটে যাওয়ায় আশপাশের অন্যান্য ট্রলারগুলোকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণ সবাই কুয়াশার আড়ালে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল সূর্যের আশায়। প্রতিটি ট্রলারের রেইলের ধারে দাঁড়িয়ে বকের মত গলা বাড়িয়ে সামনের জল দেখছে নাবিকদের দল। ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়েও শোনা যাচ্ছে তাদের উত্তেজিত গলা।
কাঁচে মোড়া হুইল হাউজে দাঁড়িয়ে পঞ্চাশ ফুট ট্রলারের প্রায় সর্বত্রই দেখতে পারছেন লোথার। সম্পন্ন হয়েছে সমস্ত প্রস্তুতি। স্টারবোর্ড রেইলের নিচে পড়ে আছে লম্বা জাল। শুকনো অবস্থাতেই এর ওজন সাড়ে সাত টন। ভিজে গেলে তো আরো কয়েকগুণ ভারি হয়ে যায়। পাঁচশ ফুট লম্বা জালটা পানিতে সত্তর ফুট গভীর পর্যন্ত পৌঁছে যায়; ঠিক যেন মিহি তার দিয়ে তৈরি একটা পর্দা। এর পেছনে লোথার পাঁচ হাজার পাউন্ডেরও বেশি খরচ করেছেন, যা সাধারণ একজন জেলের প্রায় বিশ বছরের আয়ের সমান। তার বাকি তিনটি ট্রলারও একই রকম স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রতিটি ট্রলারের পেছনে ঝুলছে আঠারো ফুট লম্বা ডিগ্রি, আর বাইরের তক্তা বা ধাতব পাতের একটির অংশ অপর একটির নিচে বিস্তৃত হয়ে থাকে এমনভাবে প্রস্তুত ডিঙ্গি নৌকা।
তীক্ষ্ণ চোখে আরো একবার সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে সন্তুষ্ট হলেন লোথার। এরপর সামনে তাকাতেই দেখলেন লাফিয়ে উঠল আরেকটা মাছ। এবার এত কাছে যে মাছটার শরীরের রঙও স্পষ্ট ধরা পড়ল চোখে। তারপর আবার পানিতে আন্দোলন তুলে টুপ করে গভীরে চলে গেল ছোট্ট মাছটা।
যেন এটাই ছিল সেই কাঙিক্ষত সিগন্যাল। সাথে সাথে জীবন্ত হয়ে উঠল পুরো মহাসমুদ্র। গাঢ় হয়ে উঠল পানির রঙ; যেন ভারি মেঘ এসে ঢেকে দিল চারপাশ। তবে এবার মেঘটা এল একেবারে অতল গভীর থেকে। স্রোতের নিচে নড়ে উঠল যেন এক জলদানব।
“এত্ত এত্ত মাছ!” বিবর্ণ আর ভঁজের দাগঅলা বাদামি মুখখানা ঘুরিয়ে লোথারের দিকে তাকাল দা সিলভা। একই সাথে হাত ছড়িয়ে বোঝাতে চাইল মাছের পরিমাণ।
এক মাইল সামনে একেবারে গভীর জল অব্দি থেকে বেরিয়ে এল বিশাল বড় একঝাক। শিকারি হিসেবে এত বছর পেরিয়ে এলেও জীবনে এরকম প্রদর্শনী লোথার আর দেখেননি। এর কাছে আফ্রিকান সূর্যকে গাঢ় পর্দা দিয়ে ঢেকে দেয়া পঙ্গপাল কিংবা কোয়েল পাখির ঝাঁকও কিছুই নয়। মাছের ঝকটা পানির উপরে উঠে আসতেই চারপাশ এতটা সাদা আর তুষারের ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল যে, তীরবেগে ছুটে চলা ট্রলারগুলোর নাবিকেরা পর্যন্ত মন্ত্রমুগ্ধের মত নিশ্চুপ হয়ে গেল।