“তুমি আমার কাছে বাবার মতই ছিলে হেনি” আস্তে করে বলে উঠল ম্যানফ্রেড, “কোনো বাবা কি হায়েনা আর শকুনের ভয়ে নিজ সন্তানকে ফেলে দেয়?”
“আমিই যদি তোমার বাবা হই তাহলে তোমার চেহারা সাদা আর আমার কালো কেন?” হেসে ফেললেন হেনড্রিক, “আমাদের মাঝে কোনো দেনা নেই আর, সব বহু আগেই চুকেবুকে গেছে।”
“আমার বাবা আর তুমি ভাই ছিলে।”
“তারপরে আরো যে কতশত গ্রীষ্ম চলে গেছে। বদলে গেছে পুরো দুনিয়া।” বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন হেনড্রিক।
“একটা জিনিস কিন্তু এতগুলো বছরেও একটুও বদলায়নি হেনি?”
“সেটা কী বাছা?”
হিরে, আমার কালো বাবা! হিরে কখনোই বদলায়নি।”
মাথা নাড়লেন হেনড্রিক, “তবে তাই হোক। চলো হিরে নিয়েই কথা বলি।”
“একটা নয়। অনেক অনেক হিরে। এমন এক জায়গায় এক ব্যাগ ভর্তি হিরে পড়ে আছে যা কেবল তুমি আর আমিই জানি।”
***
“মস্ত বড় ঝুঁকি নিতে হবে।” ভাইকে জানালেন হেনড্রিক, “কিন্তু ঝোঁপের ভেতরে ওঁৎ পেতে থাকা মানুষখেকো সিংহের মত সন্দেহ আমার পিছু ছাড়ছে মা। বাবাটা যেরকম ভয়ংকর নির্দয় ছিল আমার মনে হয় ছেলেও সেরকম হয়েছে। যদিও আমাদের ভেতরে বন্ধুত্ব স্থাপনের কথা বলছে, তবে আমার খটকা কিন্তু রয়েই গেছে।”
একদৃষ্টে আগুনের দিকে তাকিয়ে আছেন মোজেস গামা। “ও স্মাটসকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল।” স্বশব্দে উচ্চারণ করলেন মনের চিন্তা, “ও ঠিক প্রাচীন আমলের শক্তিশালী বোরাদের মতন। যারা মহান গোত্র প্রধানদের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে রক্তনদীতে সবাইকে গলা কেটে মেরে ফেলেছিল। তারপর ১৯১৪ তে’ও হয়ত পরাজিত হয়েছে। কিন্তু পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি।
শ্বেতাঙ্গদের নীতি হচ্ছে, ওর ইতিহাসও আমি দেখেছি, শান্তি আসার পরে যারা যুদ্ধে লড়েছিল ওদেরকে ভুলে যায়। আমার ধারণা পরের লড়াইয়ে শ্বেতাঙ্গরা সুটকে ঝেড়ে ফেলবে আর বোয়ারা জিতে যাবে। আর এই ছেলেটাও ওদেরই একজন।”
“তুমি ঠিক বলেছ ভাই মাথা নাড়লেন হেনড্রিক, “আমি তো ততদূর পর্যন্ত ভাবিইনি। ও আমাদের শত্রু। ওর জাত ক্ষমতায় এলে আবার আমাদেরকে কচুকাটা করবে। তাই ওকে পুলিশের হাতে তুলে দিলেই ভালো হবে।”
এবার চোখ তুলে ভাইয়ের দিকে তাকালেন মোজেস গামা। এটাই তো সবার সমস্যা। পেট কিংবা বিছানা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। ভাই তুমিও তা নিজ মুখে স্বীকার করলে। কেন ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবো না?”
“বুঝি না যে।”
“আমাদের লোকেদের ধৈর্যই হল তাদের প্রধান সমস্যা। ধূর্ত এক মেষপালকের ভেড়া হয়েই আমাদের দিন কেটে যাচ্ছে। অথচ মন চাইলেও মেষপালক আমাদের মাংসে ছুরিও বসায়।”
“যদি তাই হয় তাহলে তুমি যাদেরকে বোয়া ডাকো তারা কি আরো ভয়ংকর নয়?”
“ওদের উপরই আমাদের লোকদের পরিপূর্ণ মুক্তি নির্ভর করছে। ওদের মনের মাঝে অনেক ঘৃণা আর রাগ। ওরা ইংরেজ আর ইন্ডিয়ানকে যতটা ঘৃণা করে তার চেয়েও বেশি করে আমাদেরকে। কারণ ওরা আমাদেরই প্রাপ্য ভূমি ভোগ করছে। এরা ক্ষমতায় এলে আমাদেরকে সত্যিকারের দাস মানে কি সেই শিক্ষা দিবে। তখনই কেবল আমরা শান্ত ভাব ছেড়ে হয়ে উঠব বুনো ষাড়। তাই তোমার এই শ্বেতাঙ্গ ছেলেটা আর ওর সবকিছুর জন্য প্রার্থনা করতে হবে। আমাদের জনগণের ভবিষ্যতও ওর উপরেই নির্ভর করছে।”
বহুক্ষণ ধরে আগুনটাকে দেখলেন হেনড্রিক। তারপর কামানের গোলার মত বিশাল টাক মাথা উঠিয়ে সবিস্ময়ে ভাইকে বললেন, “মঝে মাঝে আমার কী মনে হয় জানো, তুমিই হলে আমাদের সব গোত্রের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী।”
***
গোত্রের এক চিকিৎসকের কাছে খবর পাঠালেন হেনড্রিক। সেই কবিরাজ এমন এক পুলটিশ দিল যা লাগাবার পর গরম লাগলেও আর বদ গন্ধ ছড়ালেও দ্রুত সেরে উঠল ম্যানফ্রেড। দশ দিনের ভেতরেই ভ্রমণ করার মত ফিটও হয়ে উঠল।
সেই একই কবিরাজ আবার এমন এক ভেষজ রং পাঠাল যা গায়ে মাখার পর ম্যানফ্রেডের চামড়া হয়ে গেল উত্তরে বসবাসকারী গোত্রগুলোর মতন।
ই আর পি এস থেকে ওর ট্রাভেল পেপারস ঠিক করে দিল হেনড্রিকের এক চর। এমনই এক দলের সঙ্গে চোখে সানগ্লাস পরে ওয়েনেলা ট্রেনে চড়ে বসল ম্যানফ্রেড।
অদ্ভুত লাগলেও স্বস্তি পেল যখন দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকাতে যাওয়ার জন্য ধীরগতির এই ভ্রমণে কোনো শ্বেতাঙ্গ অফিসারই ওর দিকে তেমন মনোযোগ দিল না।
ওকাহানজাতে ট্রেন থেকে নেমে বাসে চড়ে হেনড্রিকের দেশে রওনা দিল ম্যানফ্রেঙ। দুদিন পরে হেনড্রিকসহ আবার রাস্তায় নেমে এল। তবে এবারে পায়ে হেঁটে তপ্ত মরুভূমি পেরিয়ে পৌঁছাতে হবে উত্তরে। এর ঠিক দুই সপ্তাহ বাদে নীল দিগন্তে দেখা গেল উটের ক্যারাঙানের মত কোপজে।
ছোটবেলা থেকে শহর নগরে বেড়ে ওঠা ম্যানফ্রেড উপলব্ধি করল যে আজ সাথে হেনড্রিক না থাকলে এই প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা তো দূরের কথা ফেরার রাস্তাই চিনতে পারত না।
আর তাই হেনড্রিক ওকে যে কোজেতে নিয়ে এল প্রথমে তা দেখতে বাকিগুলোর মতন মনে হলেও খাড়া গ্রানাইটের পাহাড় পেরিয়ে চূড়ায় উঠতেই মনে পড়ে গেল যেন গত জনের স্মৃতি। চোখের সামনে যেন জ্বরতপ্ত বাবার শরীরটাও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ম্যানফ্রেড। কতটা কর্কশ ভাষায় বাবা ওকে নিরাপদে চলে যাওয়ার জন্য আদেশ দিয়েছিল সেটাও মনে পড়ে গেল। তবে জোর করে মাথা থেকে সেসব চিন্তা দূর করে দিল ম্যানি।