একেবারে স্থির, পাথরের মত পড়ে আছে ম্যানফ্রেড। ঠিক যেন একটা শিকারি চিতা। ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে কখন এগিয়ে আসবে শিকার। সতর্ক হয়ে আছে কেবল হলুদ একজোড়া চোখ।
তারপর আচমকাই ঘটে গেল সবকিছু। কোনো রকম ওয়ার্নিং গলার আওয়াজ কিংবা পদশব্দ ছাড়াই রাস্তার উপর দেখা গেল এক মানব শরীর। নীল আকাশের পটভূমিতে মনে হচ্ছে একটা ছায়াছবি।
ম্যানফ্রেড তো তৈরি হয়েই ছিল। সাথে সাথে কাঁধের ওপর তুলে নিল বন্দুক। টেলিস্কোপিক সাইটে চোখ দিতেই ফুটে উঠল লোকটার চেহারা।
সাদা শার্ট আর হলুদ হয়ে যাওয়া পানামা হ্যাট পরনে বৃদ্ধ এক লোক। বসন্তের উজ্জ্বল রৌদ্রে চমকাচ্ছে তার রুপালি দাড়ি। এবার আর মাথায় নয়, সোজা লোকটার বুকেই গুলি করবে বলে সিদ্ধান্ত নিল ম্যানফ্রেড।
আলতো করে মসারের ট্রিগারে চাপ দিল। সাথে সাথে কান যেন ফেটে যাবার জোগাড়। কাঁধে লাগল হাতলের গুতো।
এতদূর থেকেও হাড় জিরজিরে বুকটা ভেদ করে বুলেটটাকে বেরিয়েও যেতে দেখল ম্যানফ্রেড। ঘাসের ওপর রক্তের পুকুরে মুখ ডুবিয়ে পড়ে গেল বুড়ো। পেছনেও লম্বা একটা রক্তের রেখা।
উঠে দাঁড়িয়েই দৌড় দিল ম্যানফ্রেড। কীভাবে মরিসে পৌঁছাবে সেটা নিয়েও প্ল্যান করা আছে। আর মনে সন্তুষ্টির আনন্দ থাকায় পায়ের শক্তিও হয়ে গেল দ্বিগুণ।
পেছনে কে যেন প্রচণ্ড বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু পিছু ফিরে তাকাবারও প্রয়োজন মনে করল না ম্যানফ্রেড।
***
এক দৌড় দিয়ে চূড়ায় উঠে এল শাসা। পথের পাশেই ঘাসের উপরে পড়ে থাকা দেহটার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে আছে বাকি দু’জনে। আতঙ্ক ভরা চোখ নিয়ে দুজনেই তাকাল শাসার দিকে।
একবার শুধু মৃতদেহটার দিকে চেয়ে দেখল শাসা। বুকের উপরে দুই হাতের মুঠো ঢুকিয়ে দেয়ার মত বড়সড় একটা গর্ত।
আর কোনো আশা নেই। গুলি খাওয়ার সাথে সাথেই মারা গেছেন। নিজেকে শক্ত করে ফেলল শাসা। দুঃখ করার জন্য পরেও সময় পাওয়া যাবে। এখন প্রতিশোধ নিতে হবে।
“কে করেছে দেখেছেন?” এক নিঃশ্বাসে প্রশ্নটা করে ফেলল। “ইয়েস” লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ব্লেইন, “একঝলক দেখেছি। শর্টকাটে দৌড়ে ওডিক্রাল কপের দিকে গেছে। নীল ড্রেস।”
এই পর্বতের প্রতিটি চূড়া আর বাক শাসার মুখস্থ। তাই বুঝে গেল যে খুনি মাত্র দুই মিনিট আগে ভেগে গেছে।
“তার মানে যেদিক দিয়ে ঘোড়া যায় সেদিকে গেছে। আমি তাকে নার্সারি র্যাঙিনে গিয়ে ধরতে পারব।” আবারো ব্রেকফাস্ট রকের দিকে দৌড় দিল শাসা।
“সাবধানে! ওর কাছে রাইফেল আছে, আমি দেখেছি।” একমাত্র এ রাস্তা দিয়েই পাহাড়ে কোনো বাহন উঠানো সম্ভব। তার মানে খুনি কতটা সাবধানে পালাবার পথও প্ল্যান করে রেখেছে। কাপে যাওয়ার আরেকটা সহজ রাস্তা আছে আর তাতে অনেকখানি সময়ও বেঁচে যাবে। কিন্তু পথের মাথাটা পেতে ভুল হলেই সব গন্ডগোল হয়ে যাবে।
যাই হোক, খুঁজে পেল শাসা। কিন্তু রাস্তার একাংশ ভেঙে যাওয়াতে পুরো ৫০০ ফুট খোলা মুখ লাফ দিয়ে এপাড়ে হাঁটু গেড়ে ল্যান্ড করেই আবার উঠে দিল দৌড়।
এরপর আচমকাই মেইন ফুটপাতে এসে পড়ায় বিপরীত দিক থেকে এগিয়ে আসা খুনির সাথে ঠোক্কর খেলো শাসা।
মুহূর্তের জন্য লোকটার বিশাল দেহ আর চওড়া কাঁধের ছোঁয়া পেলেও একসাথে গড়াগড়ি করে পড়ে গেল দু’জনেই। ফলে খুনির হাত থেকে রাইফেলটা ছিটকে পড়ে গেল। কিন্তু তার পেশি শক্তির সক্ষমতা অনুভব করে চমকে গেল শাসা। সাথে সাথে বুঝে গেল এর সাথে পারবে না। খানিক বাদেই দেখা গেল ওর বুকের উপর শুয়ে আছে খুনি।
মাত্র ইঞ্চিখানেক দূরত্বে দু’জনের মুখ। লোকটার মুখে ঘামে ভেজা ঘন আর কোঁকড়ানো কালো দাড়ি, বাঁকানো নাক কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর হল হলুদ জোড়া চোখ। কেন যেন বেশ পরিচিত মনে হল। যাই হোক, তাতেই খানিকটা শক্তি পেল শাসা।
কোনোমতে এক হাত মুক্ত করেই বেল্ট থেকে বেরেটা নিয়ে খুনির মাথায় সর্বশক্তি দিয়ে দিল বাড়ি। খুলির হাড় ফাটার স্পষ্ট শব্দও কানে এল।
শাসাকে ছেড়ে ওপাশে পড়ে গেল লোকটা। হাঁচোড়-পঁচোড় করে উঠে বেরেটা লোড করতে বসল শাসা। কিন্তু নিশানা করার আগেই হঠাৎ দুই পা তুলে ওর বুকে আঘাত করল খুনি।
পিছনে গড়িয়ে গেল শাসা। বোটা থেকে গুলি বেরিয়ে গেলেও কারো গায়ে লাগল না। একই সাথে কিনার দিয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল শাসা। একঝলক দেখেই বুঝল একশ’ ফুটের আগে নিচে কোনো বাধা নেই। কিন্তু তার আগেই পাথরের কিনার দিয়ে বের হওয়া পাইনের একটা মাথা আঁকড়ে ধরে কোনমতে সামলাল ওই পতন।
সেইভাবে ঝুলন্ত অবস্থাতেই উপরে তাকাতেই খুনি লোকটাকে একপলকের জন্য ওর দিকে নিচে তাকাতে দেখল শাসা। কিন্তু সাথে সাথেই আবার উধাও হয়ে গেল সেই অদ্ভুত হলুদ চোখের মালিক। কানে এল দৌড়ে গিয়ে কারো রাইফেল লোড করার আওয়াজ।
“এখন নিশ্চয়ই আমাকে শেষ করতে আসবে।” আপন মনে ভাবতেই মনে পড়ল ডান হাতে থাকা বেরেটার কথা।
মরিয়া হয়ে বাম কনুই পাইনের মাথায় জড়িয়ে উপরের দিকে বেরেটা তা করল শাসা।
আরো একবার আকাশের গায়ে ভেসে উঠল খুনির মাথা আর কাঁধ। নিচের দিকে তাক্ করছে মসারের ব্যারেল। ঠিক সেই মুহূর্তে বেরেটা দিয়ে গুলি করল শাসা। হালকা বুলেটটা ছুটে গিয়ে লোকটার মাংসে লাগতেই সরে গেল খুনি। খানিক বাদে দূর থেকে শোনা গেল আরেকটা গলার আওয়াজ। ব্লেইনের কণ্ঠ।