“কাম অন!” মনে মনে অনুনয় করে উঠল শাসা; হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল এমনিই পঁয়ত্রিশ মিনিট নষ্ট হয়ে গেছে।
“যাই, এগুলো প্যাক করতে হবে। এখানে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না।”
কী ভেবে ডেস্কের কাছে গিয়ে ফোনের দিকে হাত বাড়াতেই বেজে উঠল যন্ত্রটা। আচমকা শব্দ শুনে ভয় পেয়ে গেলেও সাথে সাথে ছোঁ মেরে তুলে নিল রিসিভার।
“স্কোয়াড্রন লিডার কোর্টনি” আফ্রিকান ভাষায় জানতে চাইল, শাসা, “আপনিই ম্যাডাম?”
“আমি আসলে নাম্বার ভুলে গিয়েছিলাম। আবার বাসায় গিয়ে নিয়ে আসতে হল।” দৌড়ে আসাতে যেন অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছে এমন ভাবে হাঁপাচ্ছে মেয়েটা। বলল, “আগে ফোন করতে পারিনি। অনেক লোক ছিল, আমার হাজব্যান্ড” আবার থেমে দম নিল। “ঠিক আছে কোনো সমস্যা নেই।”
“না। ওরা যা করতে চলেছে তা অনেক অনেক ভয়ংকর।” বলে উঠল অচেনা নারীকণ্ঠ।
“আমাকে কি বলবেন?”
“উড বাস, ফিল্ড মার্শাল স্মুটস। ওরা তাকে খুন করবে।” এক মুহূর্তের জন্য যেন জমে গেল শাসা। সম্বিৎ ফিরতেই জানতে চাইল, “কখন তা কি জানেন?”
“আজ। ওরা তাকে আজই গুলি করবে।”
“সেটা অসম্ভব কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না শাসা। “উড বাস তো টেবিল মাউন্টেনে পিকনিক”।
“ইয়েস! ইয়েস!” ফোঁপাতে লাগল মেয়েটা, “পাহাড়ে। হোয়াইট সোর্ডও পাহাড়ে অপেক্ষা করছে।”
“ওহ মাই গড! ফিসফিস করে উঠল শাসা। মনে হচ্ছে চলার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছে। পা দুটো সীসার মত ভারি হয়ে আটকে গেছে মেঝের সঙ্গে। কোনোরকমে ঢোক গিলে কেবল বলল।
“আপনি অনেক সাহসী একজন মানুষ। যা করেছেন তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।”
এরপর ঠাস করে ক্রেডলে ফোন রেখেই সেনটেইনের ডেস্কের ড্রয়ার খুলে ফেলল। বেরেটা পিস্তল বের করে চেক করে দেখল লোড করা আছে কিনা। ম্যাগাজিনে ছয়টা গুলি; সাথে আরেকটা এক্সট্রা ম্যাগাজিন। পিস্তলটাকে বেল্টের সাথে ঝুলিয়েই দরজার দিকে দৌড় দিল শাসা।
যদিও পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ না হলে এ পিস্তল কোনো কাজেই আসবে না, তারপরেও গানরুমের কেবিনেটের তালা খুলে রাইফেল আনতে গেলে মূল্যবান সময়ই নষ্ট হবে শুধু। ওদিকে পিকনিক পার্টি চল্লিশ মিনিট এগিয়ে গেছে।
লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি বেয়ে জাগুয়ারে উঠে বসল শাসা। গুপ্তঘাতকের হাত থেকে ওর ভালোবাসার মানুষগুলোকে বাঁচাতেই হবে। বনবন করে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে আশি মাইল বেগে গাড়ি ছোটাল। পিছনের টায়ার থেকে ছিটকে বেরোল নুড়ি পাথরের ফোয়ারা। তারপরেও পনেরো মিনিট লেগে গেল। কিউরেটরের অফিসের পেছনে পার্কিং এরিয়াতে দেখা গেল ডেইমলার, বেন্টলি আর ডেনিসের প্যাকের্ড। কিন্তু জনমানুষের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
চোখ তুলতেই দেখল মাথার ওপর টাওয়ারের মত ২০০০ ফুট উঁচু পাহাড়। চোখের উপর হাত নিয়ে তাকাতেই দেখা গেল চলন্ত কয়েকটা ফুটকি। উড বাস, দাদু সবার সামনে। অনেক পেছনে মা, তারা।
দৌড় দিল শাসা। প্রথম ৩০০ মিটার উঠে মাইনেপোস্টের কাছে থেমে খানিক নিঃশ্বাস ফেলার জন্য বিশ্রাম নিল। সেখান থেকেই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে উঠে গেছে খাড়া পথ। কিন্তু পায়ে পাতলা চামড়ার সোলের জুতা থাকায় সুবিধে করতে পারছে না তেমন। ভয়ংকরভাবে হাঁপাচ্ছে শাসা। ঘামে ভিজে গেছে শার্ট। আরও এক হাজার ফুট উঁচুতে উঠতে হবে। তবে বন থেকে বের হতেই দেখল পিকনিক পার্টিও সামনেই।
দাদু আর উড বাসের কয়েক কদম পেছনে ব্লেইন। ইচ্ছে করেই আস্তে হাঁটছে যেন তার পাল্লা দিতে গিয়ে অসুস্থ না হয়ে যায় দুই বুড়ো। বাকি দল আরো পেছনে।
বুক ভরে লম্বা একটা দম নিয়ে চিৎকার করে উঠল শাসা। সাথে সাথে পিছু ফিরে তাকাল মেয়েরা।
“স্টপ!” সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠল শাসা, “স্টপ।”
মেয়েদের একজন হয়ত ম্যাটি হাত নাড়ল। কিন্তু না থেমেই আবার হাঁটতে শুরু করল পুরো দল। হয়ত শাসাকে চিনতে পারেনি। কিংবা স্টপ কথাটা শোনেনি।
সময় নষ্ট হচ্ছে ভেবে আবার দৌড় দিল শাসা। জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরটা। ধপধপ লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। পা দুটো আর ছুটতে চাইছে না। তারপরেও কেবল ইচ্ছেশক্তির জোরেই ছুটল সামনের দিকে।
ঠিক সেই মুহূর্তে দশ কদম দূরে থাকতেই পিছন ফিরে তাকাল তারা।
“শাসা!” বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল মেয়েটা, “তুমি এখানে?”
ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল শাসা। অ্যানা আর মাকেও ছাড়িয়ে চলে গেল।
“কী হয়েছে শাসা?”।
“পরে!” আর কোনো শব্দ খুঁজে পেল না বেচারা। অবশ পা দুটো টেনে কেবল ছুটছে।
কিন্তু ততক্ষণে মোড় নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে দুই বুড়ো। ওদের বিশ কদম পেছনে ব্লেইন। আবার চিৎকার দিল শাসা।
অনেক দূরে হলেও স্পষ্ট কানে এল মসারের তীক্ষ্ণ শিষ। শোনার সাথে সাথে কোথা থেকে নব উদ্যম এসে ভর করল ওর শরীরে। এক পাথর থেকে আরেক পাথরে লাগিয়ে লাফিয়ে সামনে যেতেই মনে হল কেউ যেন চিৎকার করছে। নাকি কানে বাজছে। তার নিজেরই বুকে হাতুড়ির বাড়ি কে জানে।
***
সারারাত নিজের গোপন আস্তানায় শুয়েছিল ম্যানফ্রেড ডি লা রে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে উঠে খানিক এক্সারসাইজ করে কাটিয়ে নিল হাত-পায়ের জড়তা। তারপর ব্লাডারও খালি করে ফেলল।
আবার জায়গামত এসে ওভারকোট আর জার্সি খুলে পুঁটুলি বানিয়ে রেখে দিল পাথরের নিচে। প্যারেডের সেকেন্ড হ্যান্ড কাপড়অলার কাছ থেকে কেনায়। এগুলো দিয়ে কেউ তাকে খুঁজে বের করতে পারবে না। তেরপলের ওপর সোজা হয়ে গান সাইটে চোখ রাখতেই দেখা গেল বাধা দিচ্ছে কয়েকটা ঘাসের ডগা। সেগুলোও মুচড়ে ভেঙে ফেলে দিল। এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চারপাশ।