পাশে চলে এলেন লোথার। জেটির মাঝ বরাবর মানুষের একটা জটলা।
“শাসা!” মাতৃসুলভ উদ্বেগে চিৎকার করে উঠলেন সেনটেইন। “শাসা কোথায়?” হঠাৎ জানালার ভেতর দিয়ে লাফ দিয়ে জেটির দিকে ছুটলেন লোথার। চিৎকাররত নাবিকদেরকে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সোজা এগিয়ে গেলেন জেটির কিনারে।
“ম্যানফ্রেড!” তীক্ষ্ণ কণ্ঠে গর্জন করে বললেন, “থামো! ওকে ছাড়ো!”।
হেডলক দিয়ে পেঁচিয়ে হাত ঘুরিয়ে রোগা-পটকা ছেলেটার মাথায় মারল তার নিজের ছেলে। শাসার খুলি ফাটার আওয়াজ পেলেন লোথার।
“বেকুব কোথাকার!” এগিয়ে গেলেন লোথার। কিন্তু ভিড়ের শব্দে কিছুই শুনল না দুই ছেলে। শাসার জন্য সত্যিই ভয় পেলেন লোথার, এও ভালোভাবেই বুঝলেন যে, ছেলেটা আহত হলে সেনটেইনের প্রতিক্রিয়া কী হবে।”ওকে ছাড়ো!” কিন্তু লোথার পৌঁছাবার আগেই জেটির কিনার বেয়ে পড়ে গেল যুদ্ধরত জুটি। “ওহ, ঈশ্বর।” তাড়াতাড়ি কিনারে গিয়ে দেখলেন যে চকচকে মাছের মধ্যে প্রায় ডুবে গেছে দুজন।
মইয়ের মাথায় পৌঁছাতে চাইলেও লড়াইয়ের এক মুহূর্তও মিস করতে নারাজ কৃষ্ণাঙ্গ নাবিকদের ভিড় ঠেলে কিছুতেই পৌঁছাতে পারছেন না লোথার। অতঃপর দুই হাতে ঘুসি মেরে নিজের লোকদেরকে সরিয়ে ট্রলারের ডেকে নিচে এলেন লোথার।
অন্য ছেলেটার ওপর বসে তার মাথা আর কাঁধ মাছের স্তূপের নিচে ঠেসে ধরেছে ম্যানফ্রেড।
তার নিজের মুখে অসংখ্য ক্ষতের আঁকিবুকি আর ক্রোধ। রক্তমাখা ফোলা ঠোঁটে অনবরত বিভিন্ন ধমক দিয়ে চলেছে ম্যানফ্রেড। শাসার মাথা আর কাঁধ দেখা না গেলেও মাথায় গুলি খেয়ে আহত লোকের স্নায়ুবিহীন পদক্ষেপের মত নড়ছে দুটো পা।
ছেলের কাধ ধরে সরিয়ে নিয়ে আসতে চাইলেন লোথার। মনে হল এক জোড়া ম্যাস্টিফকে আলাদা করতে চাইছেন। প্রচণ্ড শক্তি খাটাতে হল। ম্যানফ্রেডকে তুলে হুইল হাউজের দিকে ছুঁড়ে মারলেন। একই সাথে শাসার পা ধরে মরা মাছের চোরাবালি থেকে টেনে তুললেন।
“তুমি ওকে মেরে ফেলেছে, নিজ পুত্রের দিকে তাকিয়ে ঘোঁত ঘোত করে উঠলেন লোথার। চেহারা থেকে রক্ত সরে গিয়ে ছাই রঙা হয়ে গেল ম্যানফ্রেডের মুখ। কাঁপতে শুরু করল।
“আমি তো তা চাইনি, পা। আমি চাইনি-”।
শাসার নিথর মুখের ভেতরে মরা মাছ ঢুকে দম বন্ধ করে দিয়েছে। নাকের ফুটো দিয়ে বের হল মাছের কাদার বুদবুদ।
“বেকুব কোথাকার! হাঁদারাম একটা!” আঙুল ঢুকিয়ে শাসার মুখ থেকে মাছ বের করে আনলেন লোথার।
“আমি দুঃখিত, পা। আমি সত্যিই এটা চাইনি।” ফিসফিস করে উঠল ম্যানফ্রেড।
“যদি তুমি ওকে মেরে ফেলতে তাহলে বুঝতেও পারছে না যে ঈশ্বরের দৃষ্টিতে তা কত বড় অপরাধ হত।” শাসাকে কোলে তুলে নিলেন লোথার।
“তুমি তোমার নিজের নির্মম সেই সত্যটা উচ্চারণ না করে কেবলমাত্র খানিক জোর দিয়েই মইয়ের দিকে ঘুরলেন লোথার।
“আমি ওকে হত্যা করিনি।” ভয় পেয়ে গেল ম্যানফ্রেড, “ও তো মারা যায়নি। ঠিক হয়ে যাবে, তাই না পা?” …
“না।” গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন লোথার। “আর কখনো ঠিক হবে না।” অচেতন শরীরটাকে বইয়ে নিয়ে জেটিতে উঠে গেলেন লোথার।
নিঃশব্দে সরে জায়গা করে দিল সকলে, ম্যানফ্রেডের মত তারাও অপরাধবোধে ভুগছে।
“সোয়ার্ট হেনড্রিক,” গলা চড়িয়ে ডাকলেন লোথার, “তুমি তো সবকিছু জানো। কেন থামালে না?”
সৈকত থেকে ফ্যাক্টরি যাবার পথে অপেক্ষা করছিলেন সেনটেইন। শাসার অসার দেহ নিয়ে তার সামনে থেমে গেলেন লোথার।
“ও মারা গেছে” অসহায়ের মত বিড়বিড় করে উঠলেন সেনটেইন।
“না।” মন থেকেই কথাটা বললেন লোথার। আর এর সত্যতা প্রমাণের জন্যই যেন গুঙ্গিয়ে উঠে বমি করল শাসা।
“তাড়াতাড়ি।” কাছে এগিয়ে এলেন সেনটেইন। “তোমার কাঁধে উল্টো করে ফেলে নাও। নতুবা নিজের বমিতেই দম বন্ধ করে ফেলবে।”
শাসার ঝুলন্ত দেহকে ব্যাগের মত কাঁধের উপর ফেলে শেষ কয়েক গজ দৌড়ে অফিসে চলে এলেন লোথার। টেবিল খালি করে দিলেন সেনটেইন।
“ওকে এখানে শোয়াও।” দুর্বলভাবে উঠে বসার চেষ্টা করল শাসা। নিজের ড্রেসের হাতা দিয়ে ছেলের নাক-মুখ মুছিয়ে দিলেন সেনটেইন।
“এটা তোমার বেজন্মাটার কাজ।” ডেস্কের ওপাশ থেকে অগ্নিদৃষ্টিতে লোথারের দিকে তাকালেন সেনটেইন। “ও আমার ছেলের সাথে এমন করেছে তাই না?”
চোখ সরিয়ে নেবার আগে লোথারের মুখে উত্তরও পেয়ে গেলেন।
“এখান থেকে যাও।”
শাসার ওপর ঝুঁকে এলেন সেনটেইন। “তুমি আর তোমার বেজন্মাটা তোমাদের দুজনকেই আমি দেখে নেবো। এখন আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হও।”
***
ওয়ালবিস বে’ থেকে বেরিয়ে রাস্তাটা বিশাল সব কমলা রঙের বালিয়ারির জট পাকানো উপত্যকার মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে।
শক্ত হাতে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন সেনটেইন। ইঞ্জিনকে এতটুকুও থামতে দিচ্ছেন না। এমনকি গোলকধাঁধার মত অঞ্চলে যেখানে অন্যান্য যানবাহনও গর্তে ডুবে যায় বড়সড় হলুদ গাড়িটাকেও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ঠিকই সোজা রেখেছেন।
রেসিং ড্রাইভারদের মত বত্র মুষ্ঠিতে ধরে রেখেছেন হুইল। চামড়ায় মোড়ানো সিটে সোজা বসে একেবারে পুরোটা বাঁক দেখতে পাচ্ছেন। এমনকি বালির ফাঁদে আটকে গেলে ডেইমলারকে ধাক্কা দেবার জন্য ব্যাক সিটে দু’জন কৃষ্ণাঙ্গ পরিচারককে নিয়ে ভ্রমণের নীতিরও তোয়াক্কা করেননি সেনটেইন। খনির বাইরে রাস্তা যত খারাপই হোক না কেন, মাকে কখনো পাঁকে আটকে যেতে দেখেনি শাসা।