ডুবে যাচ্ছে শাসা। চিৎকার করার চেষ্টা করতেই একটা মরা মাছ ওর খোলা মুখে ঢুকে গলায় গিয়ে আটকে গেল। অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে সমানে হাত পা ছুড়ছে; কিন্তু ছাড়ছে না ম্যানফ্রেড। গলায় মাছের মাথা আটকে থাকায় মনে হল দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। মাথার ভেতরে বাতাসের মত শো শো শব্দ হচ্ছে; অন্ধকার হয়ে এল দৃষ্টিশক্তি। এমন সময় উপরের জেটি থেকে শোনা গেল খুনে উল্লাস।
“আমি মারা যাচ্ছি” কেমন যেন বিস্ময় বোধ করল শাসা। “আমি ডুবে যাচ্ছি-” অচেতন হয়ে পড়ায় বাধা পেল চিন্তা।
***
“তুমি এখানে আমাকে ধ্বংস করতে এসেছে,” বন্ধ দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করলেন লোথার ডি লা রে। “এতদূর কষ্ট করে এসেছে স্বচক্ষে দেখে আনন্দ লুটতে।”
“নিজেকে এত বেশি গুরুত্ব দিও না।” নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলেন সেনটেইন। “তোমার উপরে আমার এতটুকুও আগ্রহ নেই। আমি কেবল আমার বিনিয়োগের নিরাপত্তা দিতে এসেছি। পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড, সাথে সুদ।”।
“তাহলে আমাকে কাজ করতে বাধা দিতে না। এক হাজার টন মাছ। পেয়েছি, যা আগামীকাল সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের মধ্যে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডে পরিণত হবে।”
অধৈর্য হয়ে হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন সেনটেইন। “তুমি আসলে কল্পনার দেশে বাস করছে। তোমার এই মাছের কোনো নেই। এসব কেউ চায় না। পঞ্চাশ হাজার তো বহু দূরের কথা।”
“অবশ্যই এর মূল্য আছে, মাছের খাবার, ক্যান তৈরি
আবারো লোথারকে চুপ করতে ইশারা করলেন সেনটেইন।
“তুমি সংবাদপত্র পড়ো না? এই মরুভূমিতে কোনো খবরই রাখো না, নাকি? জানো না যে দুনিয়ার ভাড়ারগুলো সব অপ্রয়োজনীয় জিনিসে ভরে উঠেছে?”
“না, এটা সম্ভব না।” জেদের সুরে বলে উঠলেন লোথার। “স্টক মার্কেটের কথা অবশ্যই শুনেছি, কিন্তু মানুষকে খেতেও তো হবে।”
“তোমাকে নিয়ে আমি অনেক কিছুই ভেবেছি, কিন্তু এতটা নির্বোধ হবে বলে কখনো ভাবিনি।” মনে হল কোনো শিশুর সাথে কথা বলছেন সেনটেইন। “দুনিয়াতে কী ঘটছে বুঝতে চেষ্টা করো। সবরকম বাণিজ্য বন্ধ। ফ্যাক্টরিগুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে। বড় শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে বেকার।”
“এসব তুমি তোমার কাজের অজুহাত হিসেবে বলছো। আমার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিচ্ছো।” সেনটেইনের দিকে এগিয়ে এলেন লোথার। “বহু আগে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার জন্য আমাকে শাস্তি দিতে তাড়া করছে।”
“ঠিক তাই।” খানিকটা পিছিয়ে এলেও লোথারের চোখে চোখে তাকিয়ে রইলেন সেনটেইন। “ক্ষমার অযোগ্য, ভয়ংকর এই নিষ্ঠুর অপরাধের জন্য তোমাকে আমি যে শাস্তিই দিই না কেন যথেষ্ট হবে না। ঈশ্বর জানেন সে
“আর সন্তান?” শুরু করলেন লোথার, “যে সন্তানকে তুমি আমার কাছে ফেলে-” এই প্রথমবারের মত সেনটেইনের শান্ত অভিব্যক্তির মাঝে করাঘাত করলেন লোথার।
“তোমার ওই বেজন্মার কথা আমার সামনে তুলবে না।” এক হাত দিয়ে আরেক হাত ধরে নিজের কাঁপুনি থামালেন সেনটেইন।
“ও আমাদের ছেলে। এটা তো তুমিও অস্বীকার করতে পারবে না। তুমি কি ওকেও ধ্বংস করতে চাও?” লোথারের দাবি।
“ও তোমার ছেলে।” অস্বীকার করলেন সেনটেইন। “ও তো আমার অংশই নয়। তাই এতে আমার সিদ্ধান্তেরও নড়চড় হবে না। তোমার ফ্যাক্টরি পুরোপুরি দেউলিয়া হয়ে গেছে। তাই আমার বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারের আশা তো বাদই দিলাম, একটা অংশ ফেরত পেলেই বাঁচি।”
এমন সময় খোলা জানালা দিয়ে ভেসে এল বহু মানুষের কণ্ঠস্বর। এতদুর থেকেও সকলের উত্তেজিত গলা পাওয়া যাচ্ছে। যেন রক্তের নেশায় মত্ত হয়ে উঠেছে একপাল হাউন্ড। কিন্তু লোথার কিংবা সেনটেইন কেউই সেদিকে খেয়াল করলেন না।
“আমাকে একটা সুযোগ দাও সেনটেইন।” নিজের কণ্ঠের আকুতির সুরে নিজেই বিরক্ত হলেন লোথার। জীবনে কখনো কারো কাছে হাত পাতেননিঃ কিন্তু সবকিছু নতুন করে শুরু করার সম্ভাবনাও দেখছেন না। এর আগেও দুবার সর্বস্ব হারিয়েছেন। কেবল সাহস আর দৃঢ় সংকল্প টিকে ছিল। প্রতিবারই শত্রু ছিল ইংরেজ এবং শূন্য থেকে নিজ ভাগ্য গড়ে তুলেছেন লোথার।
কিন্তু এবার আর পারছেন না। তাঁর সন্তানের জননী, সেই ভালোবাসার নারী, ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করুন এখনো ওকে ওরকমই ভালোবাসেন। ছেচল্লিশ বছর বয়সে শরীরে এখন আর তরুণদের মত উদ্দাম নেই। সেনটেইনের চোখেও যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল অনুকম্পা।
“আমাকে একটা সপ্তাহ কেবল একটা সপ্তাহ সময় দাও সেনটেইন।” বললেও সাথে সাথে নিজের ভুল বুঝতে পারলেন লোথার।
বাইরে প্রকাশ না পেলেও সেনটেইনের চোখ দেখে ঠিকই বুঝতে পারলেন যে এই মুহূর্তের জন্য, লোথারের হেনস্থা দেখার প্রতীক্ষাতেই বসেছিলেন সেনটেইন।
“আমার খ্রিস্টান নাম ধরে না ডাকতে তোমাকে মানা করেছিলাম। যখন জানতে পেরেছি যে তুমি আমার সবচেয়ে ভালোবাসার দু’জন মানুষকে হত্যা করেছে তখনই বারণ করেছি। এখন আবারো বলছি।”
“এক সপ্তাহ। কেবল এক সপ্তাহ।”
“আমি ইতিমধ্যেই তোমাকে দুই বছর দিয়েছি।”
এইবার মাথা ঘুরিয়ে খোলা দরজার দিকে তাকালেন সেনটেইন। মনে হচ্ছে যেন ষাড়ের লড়াইয়ের রক্তাক্ত গর্জন।
“আরেকটা সপ্তাহ দেয়া মানে বেড়ে যাবে তোমার ঋণের বোঝা আর আমার লোকসানের পরিমাণ।” মাথা ঝাঁকালেন সেনটেইন; কিন্তু দেখলেন লোথার একদৃষ্টে জানালা দিয়ে বাইরে কী যেন দেখছেন, “নিচের জেটিতে কী হচ্ছে?” জানালার শার্সিতে হাত রেখে সৈকতে তাকালেন সেনটেইন।