“আমার নাম কোর্টনি” ছেলেটাকে নিজের পরিচয় দিল শাসা কোর্টনি। “আমার মায়ের নাম মিসেস সেনটেইন ডি থাইরী কোর্টনি।” নামগুলো উচ্চারণের সাথে সাথে সচরাচর যেমন অভিব্যক্তির দেখা পায় এবারে তা অনুপস্থিত থাকায় আস্তে করে জানতে চাইল, “তোমার নাম?”
“আমার নাম ম্যানফ্রেড।” ঘন কালো চোখের ভ্রু বাঁকা করে আফ্রিকান ভাষায় উত্তর দিল ম্যানফ্রেড, “ম্যানফ্রেড ডি লা রে। আমার দাদা, বাবা আর পুরো বংশই ডি লা রে। তারা যতবার ইংরেজদের মুখোমুখি হয়েছেন ততবারই গুলি ছুঁড়েছেন।”
অপ্রত্যাশিত এই আঘাতে শাসার গালে রঙ জমলেও ফিরে যেতে পারল না। হুইল হাউজের জানালায় হেলান দিয়ে এদিকে দেখছে এক বুড়ো। দুজন কৃষ্ণাঙ্গ নাবিকও এগিয়ে এল।
“আমরা, ইংরেজরা বিদ্রোহীদেরকে হারিয়ে ১৯১৪ সালে যুদ্ধে জিতেছি।”
“আমরা!” বাকিদের দিকে তাকাল ম্যানফ্রেড। “চুলে সুগন্ধি লাগানো এই ছোট্ট ভদ্রলোক নাকি যুদ্ধে জিতেছেন।” মিটিমিটি হেসে উৎসাহ দিল নাবিকেরা। “গন্ধে মনে হয় নাম হবে লিলি, দ্য পার্ফিউম সোলজার। অন্যদিকে ঘুরতেই শাসা প্রথমবারের মত উপলব্ধি করল যে ছেলেটা ওর চেয়ে ইঞ্চিখানেক লম্বা হবে। তার মানে তুমি ইংরেজ, তাই না লিলি?”
একটা গরিব শ্বেতাঙ্গ ছেলের বুদ্ধি যে এত সুরসিক হতে পারে ভাবতে পারেনি শাসা।
“অবশ্যই, আমি ইংরেজ। মনেপ্রাণে চাইছে এই পরিস্থিতি থেকে সরে পড়তে। কারণ ঘটনার উপর থেকে ওর নিয়ন্ত্রণ সরে যাচ্ছে।
“তাহলে তো নিশ্চয় লন্ডনে থাকো, তাই না?” এখনো জেদ করছে ম্যানফ্রেড।
“আমি কেপটাউনে থাকি।…
“হাহ!” ম্যানফ্রেডের দর্শক এখন বেড়ে যাচ্ছে। নিজের ট্রলার থেকে চলে এলেন সোয়ার্ট হেনড্রিক। নাবিকেরাও ভিড় করেছে।
“এ কারণেই এদেরকে সোতপিয়েল বলে।” ঘোষণা করল ম্যানফ্রেড।
খোঁচা খেয়ে জ্বলে উঠল শাসা। “সোতপিয়েলের এক পা লন্ডনে আর আরেক পা কেপটাউনে।” নাবিকেরা সমস্বরে হাততালি দিয়ে উঠতেই মরিয়া হয়ে উঠল শাসা। জেটিতে ছেলেটার ঠিক নিচে চলে এল।
তারপর আচমকা লাফ দিল। এত জলদি আক্রমণ! ম্যানফ্রেড ভেবেছিল কথার মাধ্যমে আরো খানিকক্ষণ শাসাকে অপমান করবে।
নিজের শরীরের সমস্ত ভার আর ক্ষোভ নিয়ে ছয় ফুট উপর থেকে ম্যানফ্রেডের ওপর পড়ল শাসা। হুশ করে বেরিয়ে গেল ম্যানফ্রেডের বুকের বাতাস। একসাথে জড়াজড়ি করে দুজনে মিলে গড়িয়ে পড়ল মরা মাছের জমির উপর।
ম্যানফ্রেডের শক্তি দেখেও চমকে গেল শাসা। ছেলেটার হাত কাঠের গুঁড়ির মত শক্ত আর আঙুল যেন কসাইয়ের হুক। কেবল বুকের বাতাস বেরিয়ে হতভম্ব থাকায় বেইজ্জতির হাত থেকে বেঁচে গেল শাসা। তার বক্সিং ইনস্ট্রাকটর জক মারফির নির্দেশনাও দেরিতে মনে পড়ল;
“তোমার চেয়ে বড় কাউকে কাছে থেকে যুদ্ধ করতে বাধ্য করার সুযোগ দেবে না। মাঝখানে অন্তত এক হাতের দূরত্ব রাখবে।”
ম্যানফ্রেড খুব চাইছে ওর মুখে নখ ঢোকাতে আর হাফ নেলসন ভঙ্গিতে পা দিয়ে পেঁচিয়ে ধরতে। ডান হাঁটুর ওপর উঠে বসল শাসা; তারপর ম্যানফ্রেডও উঁচু হতেই বুকের উপর লাথি কষাল। হাঁফ ছেড়ে পিছনে গড়িয়ে গেল ম্যানফ্রেড। কিন্তু এবার শাসাও গড়ানোর চেষ্টা করতেই ডেড লকের উদ্দেশে সামনে ঝাঁপ দিল। মাথা নিচু করে ডান হাত দিয়ে ম্যানফ্রেডের হাতের বাঁধন আলগা করতে চাইল শাসা। তারপর মুক্ত হবার সাথে সাথে বাম হাত দিয়ে ঘুষি মারল।
কাছে থেকে সোজা বাম দিকে ঘুসি চালাতে বহুবার শিখিয়েছে জক।
শাসা এটা তেমন ভালো না পারলেও ছেলেটার চোখে লাগতেই মাথা পিছনে হেলিয়ে খানিকক্ষণের জন্য অন্যমনষ্ক করা গেল। ফলে নিজ পায়ের উপর দাঁড়িয়ে সরে আসার সময় পেল শাসা।
ততক্ষণে পুরো জেটি ভর্তি হয়ে গেল। রাবার বুট আর গোলগলা জার্সি পরে দলে দলে ট্রলারের কৃষ্ণাঙ্গ নাবিকেরা এসে জড়ো হল। আনন্দ উত্তেজনায় যেন মোরগ লড়াই দেখছে এমনভাবে ছেলে দু’জনকে উৎসাহ দিতে লাগল।
ফোলা চোখ থেকে জল সরিয়ে ম্যানফ্রেড এগিয়ে এলেও পায়ের নিচের মাছে বাধা পেল। ফলে কোনো রকম পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই আরেকটা ঘুসি হজম করতে হল। আহত চোখ এত ভীষণ জ্বালা করছে যে ক্রোধে চিৎকার করে হন্যে হয়ে শাসাকে খুঁজল।
মাথা নিচু করে ম্যানফ্রেডের হাতের নিচে ঢুকে আবারো বাম দিকে আঘাত করল শাসা।
এবার ম্যানফ্রেডের মুখে লাগায় ঠোঁট কেটে সাথে সাথে রক্ত ঝরতে লাগল। প্রতিদ্বন্দ্বীর রক্ত আর দর্শকদের চিৎকার শুনে নিজের ভেতরে আদিম এক সত্তার অস্তিত্ব টের পেল যেন শাসা; ম্যানফ্রেডের ফোলা গোলাপি চোখে আবার লাগাল ঘুসি।
মাথায় ঘুরছে জ’কের কথা, “মার্ক করে বারবারই একই জায়গায় মারবে।” এবার ম্যানফ্রেডের চিৎকারে আক্রোশের পাশাপাশি ব্যথার বোধও ছিল।
“সত্যিই কাজ হয়েছে” আনন্দিত শাসা হুইল হাউজের দিকে দৌড় দেয়ার চেষ্টা করতেই দু’হাত দুপাশে ছড়িয়ে হাসতে হাসতে তেড়ে এল ম্যানফ্রেড।
এ দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত শাসা হুইল হাউজের কাঠ ধরে সামনে আঘাত হানল। তার মাথা গিয়ে সোজা ম্যানফ্রেডের পাকস্থলীতে লেগেছে।
আরো একবার দম বন্ধের মত দিশেহারা হয়ে গেল ম্যানফ্রেড। হামাগুড়ি আর সাঁতার দেয়ার ভঙ্গিতে আস্তে করে জেটির কাঠের মইয়ের গোড়ায় চলে এল শাসা।
হাসছে পুরো জেটি ভর্তি দর্শক। থু করে মুখ থেকে রক্ত আর মাছের আঁশ ফেলল ম্যানফ্রেড। নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টায় ভয়ংকরভাবে ওঠানামা করছে ওর বুক।