কিন্তু হঠাৎ করেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মনে পড়ে গেল নিজ দেহের উপরে লোখারের নগ্ন, মসৃণ আর শক্তিশালী সোনালি শরীরের অনুভূতি। একই সাথে নিজের উপরেই রাগ হল আবেগের এ অংশটাকে কাবু করতে না পারার অক্ষমতার জন্য। অন্যান্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজেকে অ্যাথলেটের মতই গড়ে তুলেছেন সেনটেইন; কেবল লাগামহীন এই সুখানুভূতির আকাক্ষা তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
দরজায় দাঁড়ানো মানুষটাকে ছাড়িয়েও চোখ গেল রৌদ্রে স্নাত শাসার দিকে। তার অনিন্দ্যসুন্দর ছেলেটা কৌতূহলী হয়ে মাকে দেখছে। লজ্জা পেয়ে গেলেন সেনটেইন। নিশ্চিত যে মনের ভাব চেহারায় লুকোতে ব্যর্থ হয়েছেন।
“দরজা বন্ধ করে দাও।” খসখসে কণ্ঠে আদেশ দিলেন পুরোপুরি শান্ত সেনটেইন, “ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করো।” এরপর ঘুরে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে খানিক জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। যে মানুষটাকে ধ্বংস করতে চান তার মুখোমুখি হবার আগে আবারো নিজের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছেন সেনটেইন কোর্টনি।
***
দরজাটা বন্ধ হতে দেখে অসন্তুষ্ট হল শাসা। বুঝতে পারল গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটতে চলেছে। বিড়াল চোখঅলা বিপজ্জনক ধরনের লোকটা ওর নাম জানে। তার ওপর আবার মায়ের গাল জুড়ে রঙের এরকম পরিবর্তন আর চোখের দৃষ্টি আগে কখনোই দেখেনি, অপরাধবোধ যে নয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত। তাছাড়া শাসা যতটুকু জানে মায়ের দুনিয়াতে অস্থিরতা বলতে কিছু নেই। তাই বন্ধ দরজার ওপাশে যে কী ঘটছে জানতে খুব ইচ্ছে করছে।
“যদি তুমি কিছু জানতে চাও তাহলে নিজেই খুঁজে বের করা।” মায়ের উক্তিগুলোর একটা যদি প্রয়োগ করতে যায় তাহলে ধরা খাবার সম্ভাবনা আছে জেনেও শাসা ঘুরে অফিসের অন্য পাশের দেয়ালের কাছে চলে এল।
কিন্তু কান পেতেও বিড়বিড় শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না।
“জানালা।” চিন্তাটা মাথায় আসতেই তাড়াতাড়ি কোনার দিকে সরে এল শাসা। কিন্তু খোলা জানালার নিচে দাঁড়ানোর আগেই পঞ্চাশ জোড়া চোখের দৃষ্টির সামনে ধরা খেতে হল। মেইন গেইটের কাছে এখনো জটলা পাকিয়ে আছে ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আর তার কর্মচারীর দল। কোনার দিক থেকে শাসাকে এগিয়ে আসতে দেখেই চুপচাপ সবাই এদিকে তাকাল।
মাথা ঝাঁকিয়ে দিক পরিবর্তন করে জানালার কাছ থেকে সরে এল শাসা। তারপর সবাই তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে নিজের অক্সফোর্ড ব্যাগের পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে অলসের মত ঘুরতে ঘুরতে জেটিতে চলে এল; যেন লম্বা জেটিতে বেড়ানোটাই ওর উদ্দেশ্য ছিল। হঠাৎ করে চোখে পড়ল নোঙর করা চারটা ডুবুডুবু ট্রলার। নৌকা দেখলে সব সময়েই খুশি হয়ে ওঠে শাসা। তাই উত্তপ্ত মরুভূমির এই একঘেয়ে বিকেলের বিতৃষ্ণা কাটাতে জেটির কাঠের ওপর দ্রুত হয়ে উঠল তার পা-জোড়া।
পুরো ব্যাপারটা সত্যিই বেশ নতুন আর উত্তেজনাময়। এত মাছ আগে কখনো একসাথে দেখেনি। না হলেও হাজার টন হবে। প্রথম নৌকার সমান্তরালে চলে এল শাসা। নাকে আসছে ফুয়েল অয়েল আর মানুষের মলের দুর্গন্ধ। নৌকাটার এমনকি কোনো নামও নেই : সমুদ্রের নোনা জলে ক্ষয়ে যাওয়া বো’র উপরে কেবল রেজিস্ট্রেশন আর লাইসেন্স নাম্বার রঙ করা।
“একটা নৌকার অবশ্যই একটা নাম থাকা উচিত।” মনে মনে ভাবল শাসা। তার নিজের তেরোতম জন্মদিনে উপহার হিসেবে মায়ের দেয়া পাঁচশ ফুট লম্বা ইয়টের নাম দ্য মিডাস টাচ।
কটু গন্ধে নাক কুঁচকে ফেলল শাসা। একই সাথে নৌকাটার প্রতি অবহেলা আর এর বেহাল দশা দেখে মন খারাপ করে ফেলল।
“মা বুঝি উইন্ডহক থেকে এত দূরে কষ্ট করে এটার জন্যই এসেছে” শাসার চিন্তায় বাধা দিয়ে লম্বা আর কোনাকৃতি হুইল হাউজের দিক থেকে বেরিয়ে এল একটা ছেলে।
পরনে তালিঅলা ক্যানভাস শর্টস, পা দুটো বাদামি আর পেশিবহুল। কিন্তু খালি অবস্থাতেও ভাসমান হ্যাঁচের উপর চমৎকারভাবে ভারসাম্য বজায় রেখেছে।
হঠাৎ করেই পরস্পরকে দেখতে পেয়ে শক্ত হয়ে গেল দুজনে। নিঃশব্দে পরস্পরকে মেপে দেখল।
“খাসা একটা ফুলবাবু” আপনমনে ভাবল ম্যানফ্রেড। উপকূলের উপরে সোয়াকোপমুন্ড শহরে এরকম দুএকজনকে আগেও দেখেছে। বড়লোকের ছেলেমেয়েগুলো এরকম হাস্যকর আটোসোটো পোশাক পরে মুখে আলগা ভাব নিয়ে বাবা-মায়ের পেছনে ঘুরে বেড়ায়।
অন্যদিকে শাসা ভাবল, “গরিব সাদা-আফ্রিকানগুলোর একজন।” মা ওকে এদের সাথে খেলতে মানা করলেও এদের কয়েকজন কিন্তু বেশ মজার। তাদের খনিতে মেশিন শপের ফোরম্যানের ছেলে এত সুন্দর করে পাখিদের ডাক নকল করতে পারে যে শুনলে মনে হবে সত্যিকারের পাখির আওয়াজ। এছাড়াও ছেলেটা শাসাকে পুরনো ফোর্ড গাড়ির ইগনিশন আর কার্বোরেটর অ্যাডজাস্ট করা শিখিয়েছে। আবার এই ছেলেটারই বড় বোন, শাসার চেয়েও বছরখানেকের বড় হবে; মেয়েটা খনির পাম্প হাউজের পেছনে তাকে আরেকটা গূঢ় জ্ঞান দান করেছে। পরবর্তী সুযোগেও আবার এই অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে অধীর হয়ে আছে শাসা।
এখন ট্রলারের উপরের ছেলেটাকে দেখেও আগ্রহ হচ্ছে। চোখ ঘুরিয়ে ফ্যাক্টরির দিকে তাকাল; নাহ, মা কিছু দেখছে না।
“হ্যালো” অভিজাত আচরণের সাথে সাবধানে হাসল শাসা। তার জীবনের সবচেয়ে গুরুতুপূর্ণ পুরুষ নানা স্যার গ্যারিক কোর্টনি শিখিয়েছেন, “তুমি জন্মসূত্রেই সমাজের একটা বিশেষ অবস্থান পেয়ে গেছে। এই সুবিধার সাথে দায়িত্বও আছে। একজন সত্যিকারের ভদ্রলোক তার অধীনস্থ সকলের সাথেই সদয় আচরণ করে।”