.
রাজা হুরোতাস এবং আমি যখন যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করলাম তখন রাত নেমে এসেছে, আকাশে উঠেছে বিশাল পূর্ণিমার চাঁদ। আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব বহু পুরনো, ফলে এটা হুরোতাস অনেক আগে থেকেই জানে যে সকল আহত সৈনিককে নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে হবে, তাদের যত্ন নিতে হবে। তারপর নির্ধারণ করতে হবে শিবিরের সীমানা এবং সেই অনুযায়ী পাহারা বসাতে হবে। কেবল তার পরেই সেনাপতিরা নিজেদের কাজে মনোযোগ দিতে পারবে। ফলে এই সব দায়িত্ব পালন করতে করতে মাঝরাত পেরিয়ে গেল। তারপর আমরা দুজন ঘোড়া নিয়ে নীলনদের ঢালু পাড় বেয়ে নিচে নেমে এলাম, যেখানে নোঙর করা রয়েছে হুরোতাসের বহরের প্রধান জাহাজটি।
জাহাজে উঠতেই অ্যাডমিরাল হুই এগিয়ে এলো আমাদের স্বাগত জানাতে। হুরোতাসের পরেই হুই আমার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিদের একজন, এবং পুরনো ও প্রিয় বন্ধুর মতোই একে অপরকে স্বাগত জানালাম আমরা। তার মাথায় সেই ঘন ঝোঁপের মতো চুল এখন আর নেই, ধূসর এবং পাতলা হয়ে আসা চুলের গোছার মাঝ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে চকচকে চামড়া। কিন্তু চোখগুলো এখনো আগের মতোই উজ্জ্বল, সতর্ক। তার প্রখর রসবোধের কারণে কিছুক্ষণের মাঝেই সজীব হয়ে উঠল আমার মন। আমাদের নিয়ে ক্যাপ্টেনের কামরায় প্রবেশ করল সে, এবং নিজের হাতে হুরোতাস ও আমাকে বড় বড় দুই পেয়ালা মধু মেশানো লাল মদ ঢেলে দিল। মনে হলো এর মতো সুস্বাদু পানীয় খুব কমই খেয়েছি আমি। বেশ কয়েকবার আমার পেয়ালা ভরে দিল হুই, যতক্ষণ না ক্লান্তি এসে বাধা দিল আমাদের উচ্ছ্বসিত পুনর্মিলনীতে।
পরদিন সকালে সূর্য পরিষ্কারভাবে দিগন্তের ওপর উঠে আসা পর্যন্ত ঘুমোলাম আমরা। তারপর নদীতে গোসল করে সব ময়লা আর গতকাল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে শরীরে লাগা রক্তের দাগ ধুয়ে ফেললাম। তারপর যখন মিশর এবং ল্যাসিডিমনের যৌথ সেনাবাহিনী নদীর পাড়ে একত্র হলো, তাজা ঘোড়ায় উঠে বসলাম আমরা। আমাদের সামনে গর্বিত পদক্ষেপে কুচকাওয়াজ করে চলতে শুরু করল হুরোতাসের বাহিনী, সেইসাথে আমার দলের যারা বেঁচে ছিল। বিজয় নিশান ওড়ানো হলো, ঢাক আর বাঁশির শব্দে মুখরিত হলো বাতাস। নদীর পাড় থেকে লুক্সর শহরের বিজয়দ্বারের দিকে এগোতে শুরু করলাম আমরা, উদ্দেশ্য মিশরের নতুন ফারাও টামোসের জ্যেষ্ঠ পুত্র উটেরিক টুরোকে আমাদের বিশাল বিজয়ের সংবাদ জানানো।
তবে সোনালি শহরের দরজায় পৌঁছে দেখলাম বন্ধ করা রয়েছে দরজার পাল্লা। ঘোড়া নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে দ্বাররক্ষকদের উদ্দেশ্যে ডাক দিলাম আমি। ভেতরে ঢুকতে চাওয়ার কথা জানিয়ে বেশ কয়েকবার চিৎকার করতে হলো আমাকে। তার পরেই প্রাচীরের ওপর প্রহরীদের চেহারা উদয় হতে দেখা গেল। ফারাও জানতে চাইছেন তোমরা কারা, কেন এসেছ, প্রহরীদের প্রধান জানতে চাইল আমার কাছে। তাকে ভালো করেই চিনি আমি। তার নাম ওয়েনেগ, সুদর্শন এক তরুণ ক্যাপ্টেন। ইতোমধ্যে মিশরের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান বীরত্বের স্বর্ণ পরার সুযোগ পেয়েছে সে। আমাকে চিনতে পারেনি দেখে বেশ অবাক হলাম আমি।
তোমার স্মৃতিশক্তি অনেক দুর্বল হয়ে গেছে ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ, নিচ থেকে জবাব দিলাম আমি। আমি লর্ড টাইটা, রাজপরিষদের সভাপতি এবং ফারাওয়ের সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাধ্যক্ষ। হিকসসদের সাথে যুদ্ধে আমাদের বিশাল বিজয়ের খবর জানাতে এসেছি ফারাওকে।
এখানেই দাঁড়ান! এই কথা বলে সরে গেল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ, মাথাটা অদৃশ্য হয়ে গেল প্রাচীরের কিনারের ওপাশে। এক ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা। তারপর আরো এক ঘণ্টা।
মনে হচ্ছে নতুন ফারাও কোনো কারণে খেপে আছেন তোমার ওপর, তিক্ত হাসি হেসে আমাকে বলল রাজা হুরোতাস। কে এই নতুন ফারাও? আমি কি তাকে চিনি?
কাঁধ ঝাঁকালাম আমি। তার নাম উটেরিক টুরো। আর তোমার তাকে চেনার কথা নয়।
গত কয়েক দিনে নিজের রাজকীয় দায়িত্ব অনুযায়ী যুদ্ধক্ষেত্রে আসেননি কেন তিনি? কেন যুদ্ধ করেননি তোমার পাশে দাঁড়িয়ে?
কারণ তিনি সবে পঁয়ত্রিশ বছরের এক শিশু, এসব নীচু স্তরের লোকজনের সঙ্গ এবং তাদের রুক্ষ আচার-ব্যবহার একেবারেই সহ্য করতে পারেন না, বুঝিয়ে বললাম আমি। হাসি চাপতে গিয়ে বিদঘুঁটে শব্দ বেরিয়ে এলো হুরোতাসের নাক থেকে।
তোমার কথাবার্তায় সেই আগের মতোই ধার আছে টাইটা, একটুও কমেনি! শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন ওয়েনেগকে শহর-প্রাচীরের ওপর দেখা গেল আবার। মহান ফারাও উটেরিক টুরো দয়াপরবশ হয়ে আপনাকে শহরের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছেন। তবে তার নির্দেশ এই যে, আপনাদের ঘোড়াগুলো বাইরে রেখে আসতে হবে। আপনার সাথে যে অপরিচিত মানুষটি আছেন তিনিও ভেতরে আসতে পারবেন, তবে আর কেউ নয়।
কথাগুলোর মাঝে লুকিয়ে থাকা উদ্ধত ভাব ধরতে পেরে সশব্দে চমকে উঠলাম আমি। উপযুক্ত একটা জবাব উঠে এসেছিল ঠোঁটের ডগায়; কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিতে বাধ্য হলাম। ল্যাসিডিমন এবং সমস্ত মিশরের সেনাবাহিনী এখন আমার কথা শুনছে অখণ্ড মনোযোগের সাথে। প্রায় তিন হাজার মানুষ। এই অবস্থায় এমন কিছু বলা আমার একেবারেই উচিত হবে না।
ফারাওয়ের দয়ার সীমা নেই, জবাব দিলাম আমি। ধীরে ধীরে খুলে গেল বিশাল দরজাটা।