আমাদের আলিঙ্গনটা হলো উষ্ণ, তবে ক্ষণস্থায়ী। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হুরোতাসের কাঁধে হালকা একটা ঘুষি মারলাম। সামনে এসবের জন্য অনেক সময় পাওয়া যাবে। এই মুহূর্তে পথের ও প্রান্তে কয়েক হাজার হিকসস আমার এবং তোমার মনোযোগ আকর্ষণের অপেক্ষায় আছে, পেছন দিকে ইঙ্গিত করে বললাম আমি। একটু যেন চমকে গেল হুরোতাস। কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই সামলে নিল নিজেকে, খাঁটি আনন্দের হাসি ফুটেছে মুখে।
ক্ষমা চাইছি পুরনো বন্ধু আমার। বোঝা উচিত ছিল যে আমি পৌঁছানোর সাথে সাথেই আমার জন্য যথেষ্ট বিনোদনের ব্যবস্থা করবে তুমি। তাহলে চলো হতচ্ছাড়া হিকসসগুলোর একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলি এখনই। কী বলো?
মাথা নাড়লাম আমি, যেন রাজি নই। তোমার সব সময়ই অনেক বেশি তাড়াহুড়ো। জোয়ান ষাঁড় যখন গাভীর পালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাড়াহুড়ো করে কয়েকটা গাভির দখল নিতে চেয়েছিল তখন বুড়ো ষাঁড় কী বলেছিল জানো তো?
বলো, কী বলেছিল বুড়ো ষাঁড়, আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল হুরোতাস। আমার ছোট ছোট কৌতুকগুলোতে দারুণ মজা পায় সে। এবারও সেই মজা থেকে তাকে বঞ্চিত করতে ইচ্ছে করল না।
বুড়ো ষাঁড় বলেছিল, তার চাইতে বরং আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে যাই, গিয়ে সবকটাকে ধরি।
অট্টহাসি বেরিয়ে এলো হুরোতাসের মুখ দিয়ে। তোমার পরিকল্পনা কী বলো টাইটা। আমি জানি ইতোমধ্যে কিছু একটা বুদ্ধি করে ফেলেছ তুমি। সব সময়ই তাই করো।
পরিকল্পনাটা খুব সাধারণ, ফলে কয়েক কথায় তাকে বুঝিয়ে দিলাম আমি। তারপর লাফ দিয়ে উঠে বসলাম আমার ঘোড়ার পিঠে। একবারও পেছনে না। তাকিয়ে মেরাব এবং অন্যান্য অশ্বারোহীসহ আমার ছোট্ট দলটাকে নিয়ে টিলার ওপর উঠে এলাম। জানি যে হুরোতাস, একসময় যার পরিচয় ছিল জারাস নামে; আমার পরামর্শ সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। যদিও এখন সে একজন রাজা; কিন্তু এটা ভুলে যাওয়ার মতো বোকা নয় যে আমার উপদেশ কখনো খারাপ হয় না।
.
টিলার ওপর উঠে আসতেই দেখলাম একেবারে ক্রান্তিলগ্নে এসে উপস্থিত হয়েছি আমরা। আহত মুষ্টিমেয় কিছু মিশরীয় যোদ্ধাকে লক্ষ্য করে আবারও সামনে এগোতে শুরু করেছে। হিকসসদের দল। ঘোড়ার গতি বাড়ালাম আমি। ঢাল দিয়ে তৈরি করা দেয়ালের কাছে পৌঁছানোর মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরেই আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে শত্রুরা। ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিয়ে পেছনে পাঠিয়ে দিলাম আমি। কেউ একজন একটা ব্রোঞ্জের ঢাল ধরিয়ে দিল আমার হাতে। সামনের সারির মাঝখানে নিজের নির্দিষ্ট জায়গায় এসে দাঁড়ালাম আমি। তার পরই মরুঝড়ের মতো তীব্র শব্দ উঠল, ব্রোঞ্জের সাথে বাড়ি লাগল ব্রোঞ্জের। হিকসসদের সামনের সারির সৈন্যরা আক্রমণ করল আমাদের দুর্বল ব্যুহের ওপর। প্রায় সাথে সাথেই যুদ্ধক্ষেত্রের দুঃস্বপ্নের মতো ভয়াবহতা যেন গিলে নিল আমাকে, সময় তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলল। প্রতিটি মুহূর্ত পরিণত হলো অনন্ত কালে। আতঙ্কের কালো পর্দার মতো আমাদের চারপাশে বিস্তার লাভ করতে লাগল মৃত্যু। কতক্ষণ পরে ঠিক বলতে পারব না, এক ঘণ্টা হতে পারে বা এক শ বছর- অবশেষে অনুভব করলাম আমাদের ভঙ্গুর ব্যুহের ওপর হিকসসদের অসহ্য চাপ ধীরে ধীরে কমে আসছে। তার পরেই দেখলাম হোঁচট খেতে খেতে পিছিয়ে যাওয়ার বদলে দ্রুত গতিতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।
শত্রুদের হেঁড়ে গলায় যুদ্ধ বিজয়ের উন্মত্ত গর্জনের বদলে এখন শোনা যাচ্ছে হিকসসদের বর্বর ভাষায় নানা রকম আর্তনাদ আর আর্তচিৎকার। তার পরেই মনে হলো যেন শত্রুদের দলটা হঠাৎ ছোট হয়ে এসেছে, কমে আসছে তাদের সংখ্যা। ফলে এখন আর সামনে কী হচ্ছে তা দেখতে অসুবিধা হলো না আমার। দেখলাম হুরোতাস আমার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে, ঠিক যেমনটা আমি আশা করেছিলাম। নিজের লোকদের দুই ভাগে ভাগ করে আমাদের দুই পক্ষের পেছন দিক দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে সে। ফলে বৃত্তের মতো একটা সীমানার মাঝে বন্দি হয়ে পড়েছে হিকসসরা, ঠিক যেন কোনো জেলের জালে আটকা পড়েছে এক ঝাঁক সার্ডিন মাছ।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরে যে বেপরোয়া মনোভাব তৈরি হয় তাই নিয়ে লড়ল হিকসসরা। কিন্তু আমাদের তৈরি করা ঢালের দেয়াল তাদের সামনে এগোতে দিচ্ছে না, অন্যদিকে ল্যাসিডিমন থেকে আসা হুরোতাসের সৈন্যরাও যুদ্ধের জন্য পূর্ণ উদ্যমে তৈরি। ঘৃণিত শত্রুদের আমাদের তৈরি করা ব্যুহের দিকে ঠেলে দিতে লাগল তারা, যেভাবে কাঁচা মাংস টুকরো টুকরো করে কাটার জন্য কাঠের গুঁড়ির ওপর আছড়ে ফেলে কসাই। যুদ্ধের গতিপথ বদলে গেল খুব দ্রুত, স্বাভাবিক সংঘর্ষের বদলে শুরু হলো স্রেফ ঠাণ্ডা মাথায় খুন। অবশিষ্ট কয়েকজন হিকসস শেষ পর্যন্ত অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রক্তেভেজা পিচ্ছিল মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। প্রাণভিক্ষা চাইছে সবাই; কিন্তু তাদের আবেদন শুনে হেসে উঠল রাজা হুরোতাস।
চিৎকার করে বলে উঠল সে, আমার মা আর ছোট ছোট দুই বোনও তোদের কাছে একইভাবে ক্ষমাভিক্ষা চেয়েছিল। তোদের পাষাণ বাপ-দাদারা আমার প্রিয় মানুষগুলোকে যে জবাব দিয়েছিল আমিও তোদের সেই একই জবাব দিচ্ছি। মর হারামজাদার দল, মর!
শেষ পর্যন্ত যখন সর্বশেষ হিকসসের অন্তিম চিৎকারের প্রতিধ্বনিও বাতাসে মিলিয়ে গেল, রক্তে মাখামাখি যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝ দিয়ে নিজের লোকদের নিয়ে এগিয়ে গেল রাজা হুরোতাস। শত্রুদের কারো মাঝে জীবনের সামান্য চিহ্ন দেখা গেলেও তাকে জবাই করা হলো। আমিও স্বীকার করছি, যুদ্ধের উন্মাদনায় কিছুক্ষণের জন্য হলেও নিজের মহৎ এবং দয়ালু সত্তাটাকে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম। বেশ কিছু আহত হিকসসকে তাদের কুৎসিত দেবতা সেথের অপেক্ষমাণ বাহুবন্ধনে পাঠিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে আমি নিজেও বিজয় উদযাপনে যোগ দিলাম। যাদের জবাই করলাম তাদের প্রত্যেককে আমার পক্ষের একজন করে সাহসী ব্যক্তির স্মৃতির প্রতি উৎসর্গ করলাম মনে মনে, যারা এই একই দিনে একই যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেছে।