ঠিক তাই, মাথা ঝাঁকাল সে। তোমার পরিচিত সেই ছোট্ট জারাসই এখন ল্যাসিডিমনের রাজা।
নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছ আমার সাথে? অবাক হয়ে বলে উঠলাম আমি। দেখা যাচ্ছে আমার প্রাক্তন অধঃস্তন এখন পৃথিবীর বুকে বেশ ভালোভাবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে নিজেকে। কিন্তু তোমার কথা যদি আসলেই সত্যি হয় তাহলে আমাকে এটা বলো যে ফারাও টামোসের বোন এবং রাজকুমারী তেহুতির কী খবর, যাকে তুমি আমার অভিভাবকত্ব থেকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিলে?
তুমি আসলে বলতে চাইছ ভালোবেসে নিয়ে গিয়েছিলাম, অপহরণ শব্দটা ভুল হচ্ছে। আর তা ছাড়া এখন সে আর রাজকুমারী নয়, জোরে জোরে মাথা নাড়ল হুরোতাস। এখন সে একজন রানি, কারণ আমাকে বিয়ে করার মতো সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে দেরি করেনি সে।
এখনো কি আগের মতোই সুন্দরী আছে সে? কিছুটা উদাস গলায় প্রশ্ন করলাম আমি।
আমার রাজ্যের ভাষায় স্পার্টা শব্দের অর্থ হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দরী। এবং আমার স্ত্রীর সম্মানেই ওই শহরের নামকরণ করেছি আমি। আর তাই এখন রাজকুমারী তেহুতি হচ্ছে ল্যাসিডিমনের রানি স্পার্টা।
আর বাকিদের কী খবর, যারা আমার একই রকম প্রিয় ছিল? যাদের তুমি বহু বছর আগে তোমার সাথে উত্তরে নিয়ে গিয়েছিলে–
নিশ্চয়ই রাজকুমারী বেকাথা এবং হুইয়ের কথা বলছ তুমি, আমার কথা শেষ na হতেই বলে উঠল রাজা হুরোতাস। এখন ওরাও আমাদের মতোই স্বামী স্ত্রী। তবে হুই এখন আর সামান্য কোনো ক্যাপ্টেন নয়। এখন সে ল্যাসিডিমন নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল এবং নৌ-সেনাপতি। নদীতে যে জাহাজের বহর দেখছ সেগুলো সবই ওর অধীনে, বলে নীলনদের তীরে নোঙর করে থাকা জাহাজগুলোর বিশাল দলের প্রতি ইঙ্গিত করল সে। এই মুহূর্তে ও আমার বাকি সৈন্যদের তীরে নামানোর তদারকি করছে।
তাহলে এবার বলো রাজা হুরোতাস, এত বছর পর কেন মিশরে ফিরে এলে তুমি? জানতে চাইলাম আমি।
আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় উত্তেজিত হয়ে উঠল তার চেহারা। আমি এসেছি কারণ অন্তরের গভীরে আমি এখনো একজন মিশরীয়। আমার গুপ্তচরদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম যে মিশর এখন চরম বিপদের মুখে, হিকসস বাহিনীর হাতে পরাজয় বরণের দ্বারপ্রান্তে এসে পড়েছ তোমরা। আমাদের প্রিয় জন্মভূমিকে অপবিত্র করেছে ওই পশুগুলো। আমাদের নারীদের ধর্ষণ করেছে, খুন করেছে শিশুদের। ওদের শিকারের মাঝে আমার নিজের মা এবং দুই ছোট বোনও ছিল। তাদের ওপর নির্যাতন চালানোর পর জীবন্ত অবস্থাতেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল আমাদের বাড়ির জ্বলন্ত ধ্বংসাবশেষের মাঝে পুড়ে মরতে দেখে অট্টহাসি হেসেছিল ওই হিকসসগুলো। আমি মিশরে ফিরে এসেছি আমার মা আর বোনদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে, সেইসাথে মিশরের আর কারো কপালে যেন এমন দুর্ভাগ্য নেমে না আসে তা নিশ্চিত করতে। যদি আমি সফল হই তাহলে আমার আশা এই যে, আমাদের দুই দেশ মিশর এবং ল্যাসিডিমনের মাঝে এক দীর্ঘস্থায়ী মৈত্রী প্রতিষ্ঠিত হবে।
ফিরে আসার আগে কেন তেইশ বছর অপেক্ষা করলে তুমি?
তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে টাইটা, শেষবার যখন আমাদের দেখা হয়েছিল তখন আমরা ছিলাম স্রেফ কিছু পালিয়ে যাওয়া মানুষ তিনটে ছোট নৌকা ছিল আমাদের সম্বল। এমন এক ফারাওয়ের কাছ থেকে আমরা পালাচ্ছিলাম, যিনি আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন ভালোবাসার নারীদের কাছ থেকে।
মাথা ঝাঁকিয়ে কথাটার সত্যতা মেনে নিলাম আমি। এখন আর এটা করতে কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই, কারণ যে ফারাওয়ের কথা হুরোতাস বলছে তিনি হলেন টামোস। এবং গতকালই তার মৃত্যু হয়েছে।
রাজা হুরোতাস, একসময় যে পরিচিত ছিল জারাস নামের এক তরুণ হিসেবে, আবার বলে চলল। নিজেদের জন্য নতুন কোনো দেশ কোনো আশ্রয় খুঁজছিলাম আমরা। সেই দেশ খুঁজে পেতে এবং তাকে শক্তিশালী এবং সমীহের যোগ্য করে তোলার জন্য পাঁচ হাজারেরও বেশি দক্ষ যোদ্ধার সমন্বয়ে এক সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে এই সময়ের দরকার ছিল আমাদের।
এবং সেটা কীভাবে সম্ভব করলেন, হে মহান রাজা? ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
একটু কূটনীতি খাঁটিয়ে, আর কিছু নয়, নিষ্পাপ গলায় জবাব দিল হুরোতাস। তবে আমার চেহারায় সন্দেহের ভাব ফুটে উঠতে দেখে হেসে ফেলল সে, তারপর স্বীকার করল আসল কথা। কূটনীতির সাথে অবশ্য কিছুটা অস্ত্রবাজির মহড়া আর দখলও চালাতে হয়েছে। হাতের ইশারায় নীলনদের পুব তীরে জড়ো হতে শুরু করা শক্তিশালী সেনাবাহিনীর দিকে ইঙ্গিত করল সে। এখন যে বাহিনী তুমি দেখতে পাচ্ছ তেমন শক্তিশালী কিছু যখন তোমার সাথে থাকবে তখন খুব কম মানুষই তোমার সাথে তর্কে জড়াতে চাইবে।
এটাই বরং তোমার স্বভাবের সাথে বেশি মেলে, একটু খোঁচা মেরে বললাম আমি। মাথা ঝাঁকিয়ে এবং একটু হেসে আমার ঠাট্টা গ্রহণ করল হুরোতাস, তারপর আবার নিজের কথায় ফিরে গেল।
আমি জানতাম এই মুহূর্তে তোমাকে সাধ্যমতো সাহায্য করাটা একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে আমার দায়িত্ব। আরো এক বছর আগেই আসতাম আমি; কিন্তু তখনো আমার নৌবাহিনী এতটা শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি যে আমার পুরো সেনাবাহিনীকে বহন করতে পারবে। আরো জাহাজ তৈরি করতে হয়েছে আমাকে।
তাহলে তোমাকে উষ্ণ স্বাগতম জানাচ্ছি আমি। একেবারে সঠিক মুহূর্তে এসে উপস্থিত হয়েছ তুমি। আর এক ঘণ্টা পরে এলেই দেখতে অনেক দেরি করে ফেলেছ। এক লাফে ঘোড়া থেকে নামলাম আমি; কিন্তু আমার আগেই নিজের ঘোড়া থেকে নেমে পড়েছে হুরোতাস। নিজের অর্ধেক বয়সী কোনো মানুষের মতো ক্ষীপ্র ওর চালচলন, দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো আমার দিকে। আপন ভাইয়ের মতো পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলাম আমরা। অন্তরের গভীরে তো আমরা তাই। যদিও হুরোতাসের জন্য কেবল ভ্রাতৃসুলভ ভালোবাসা নয়, বরং আরো বেশি কিছু অনুভব করছি আমি। সে শুধু আমার প্রিয় মিশরকে নিষ্ঠুর ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচানোর উপায় বয়ে আনেনি, তার সাথে এটাও বোঝা যাচ্ছে যে, আমার প্রিয় তেহুতিরও খবর নিয়ে এসেছে, যে কিনা রানি লসট্রিসের মেয়ে। আমার দীর্ঘ জীবনে এই দুই নারীকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবেসে এসেছি আমি।